উপেক্ষিতা এক শাহজাদী জাহানারা

হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগা। ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই রয়েছে। চাদর আর ডালার পসরা।আতর-ফুলের গন্ধ। মনোস্কামনা, শুভকামনা চেয়ে সুফি সন্তের দরবারে মানুষ। রাজা-প্রজা, বিখ্যাত আর সাধারনের কোনও তফাৎ নেই এ দরবারে।

সন্ত নিজামুদ্দিনের সমাধির কাছেই রয়েছে মুঘল কবি আমির খসরুর সমাধি। সে সমাধি অগোচরে। তেমনি অগোচরে রয়ে গিয়েছে আরও এক সমাধি। এই অঞ্চলেই গোরের মাটিতে শায়িত মুঘল সাম্র্যাজ্যের এক অমিত ক্ষমতাবান নারী। জাহানারা বেগম।

সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁকে ‘সাহিবাত-উল-জমানি’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। মুমতাজ মহল ওরফে আরজুমান বানু বেগম এবং সম্রাট শাহজাহানের প্রথমা কন্যা জাহানারা বেগম। ১৬১৪-তে আজমীর নগরে তাঁর জন্ম হয়েছিল। তাঁর নাম রেখেছিলেন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর। জাহানারা নামের মানে যিনি জগৎকে সাজিয়ে তোলেন। নিজের নামের মান রেখেছিলেন তিনি।

 

Jahanara1

 

অপরূপা সুন্দরী ছিলেন। প্রখর মেধা ছিল তাঁর। মুমতাজের সৌন্দর্য আর নূরজাহানের বিচক্ষণতা এই দু’য়ের মিশেলে গড়ে উঠেছিলেন জাহানারা। আরবি, ফার্সি শিখেছিলেন। সাহিত্য, শিল্পকলা কিছুটা চিকিৎসা শাস্ত্রের পাঠও নিয়েছিলেন। শের শায়রীতে কলম চলত। ফার্সি ভাষায় বেশ কিছু বইও লিখেছিলেন। খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির জীবনী লিখেছিলেন। সেই পান্ডুলিপির খোঁজও পাওয়া যায় পরে। আরও কিছু সুফি সাধকদের নিয়ে লিখেছিলেন। তাঁর নিজস্ব গ্রন্থাগার ছিল। 

মুঘল রাজ পরিবারে জন্ম হলেও নিটোল শৈশব তাঁর ছিল না। ছোটবেলা থেকে যুদ্ধ, হিংসা, রাজনীতি, বিশ্বাসঘাতকতা হাজারো ঘটনার জটিল আবর্তে বড় হয়ে ওঠা। মুঘল বাদশাহদের জেনানা মহলেও রাজনীতি কম ভয়ঙ্কর ছিল না। সে সব দেখতে দেখতেই তাঁর বেড়ে ওঠা।     

আকবরের নিয়ম অনুযায়ী মুঘল পরিবারের কন্যাদের বিবাহের অনুমতি ছিল না। সিংহাসন নিয়ে সংঘাত এড়াতে এমন ব্যবস্থা। জাহানারা নিজে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সব ক্ষেত্রেই।

বয়ঃসন্ধিতে পা দিয়েই পেয়ে গিয়েছিলেন ‘বেগমসাহেব’ খেতাব। শাহজাহানকে দ্যুতক্রীড়ায় হারাতেন। সেই অবসরেই রাজপ্রাসাদ এবং সৌধ নির্মাণ নিয়ে আলোচনা চলত। অত্যন্ত প্রিয় সন্তান ছিলেন তিনি বাদশাহের। নির্ভর করতেন কন্যার ওপর।  

শোনা যায় শাহজাহানের তাজমহল নির্মাণের পরিকল্পনাতেও জাহানারা ছিলেন। তবে জাহানারার নাম সবচেয়ে আলোচিত হয় চাঁদনী চকের স্রষ্টা হিসেবে। আজকের দিল্লি ৬ অঞ্চল তখন পরিচিত ছিল শাহজাহানাবাদ নামে। জামা মসজিদের পরিকল্পনাতেও জাহানারার অবদান ছিল। চাঁদনীচকের মাঝখানে ছিল একটি বড় জলাশয়। যমুনা থেকে খাল কেটে তৈরি করা হয়েছিল সেটি। তার উত্তরে বিশ্রামাগার। দক্ষিণে বাগিচা আর স্নানের ঘাট। চাঁদনি চক ও  লাগোয়া তিনটি বাজার ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়।

 

Jahanara2

 

পূর্ণিমার রাতে জলাশয়ের মাঝখানটিতে চাঁদের ছায়া পড়ত। সেই থেকে মহল্লার নাম হয়ে যায় চাঁদনি লাহরী গেট থেকে ফতেপুরি মসজিদ পুরো চত্বরই লোকমুখে নাম হয়ে যায় ‘চাঁদনি চক’।   

‘ট্রাভেলস ইন দ্য মোগল এম্পায়ার’ ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের লিখেছেন সে কথা। জাহানারার ওপর শাহজাহান এতটাই নির্ভর করতেন যে নিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়েছিলেন কন্যার ওপর। বাদশাহের জন্য যে খাবার প্রস্তুত হত তাতে কড়া নজর থাকত কন্যার। ‘রয়্যাল টেবিলে’ আসার আগে সমস্ত পদ নিরাপদ কিনা পরীক্ষা হত তাঁর কড়া নজরদারিতে।

ভাই দারাশুকো অত্যন্ত কাছের ছিলেন জাহানারার। প্রায় মাতার মতো স্নেহ করতেন। দুজনে একসঙ্গে কাব্য ও চিত্রকলার চর্চা করতেন। দুজনেই সুফি মনোভাবাপন্ন ছিলেন।

কাব্য এবং শিল্পকলায় বুঁদ হয়ে থাকা জাহানারার জীবনে প্রথম ধাক্কা আসে মুমতাজ মহলের মৃত্যুর পর। জাহানারার যখন ১৭ বছর বয়স তখন মৃত্যু হয় মা মুমতাজের। সম্রাট শাহজাহান ভেঙ্গে পড়েন। অন্দরের ঘটনা প্রবাহ প্রভাব ফেলে রাজপাটেই। সেই সময় শাহজাহানের দায়িত্ব নেন জাহানারা। সেই সঙ্গে হয়ে ওঠেন বাকি ভাইবোনেদের নির্ভরস্থল। হয়ে ওঠেন মালেকা-এ-হিন্দুস্থান পদশাহ বেগম। শাহজাহানের সাম্রাজ্যে প্রধান পরামর্শদাতা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। আচমকাই যেন বদলে যায় তাঁর পৃথিবীটা। পুরোদস্তুর পা রাখেন ক্ষমতার অলিন্দে। আড়ালে থেকে পিতার পরামর্শদাতা নয়। একেবারে সামনে থেকে। তাঁকে ঘিরে থাকত মুঘল রাজদরবারের নানা ক্ষেত্রের ক্ষমতাশালী কৌশলীরা। বিদেশি প্রতিনিধিরাও।

জাহানারার নিজস্ব বাণিজ্য তরী ছিল। তাঁর নিজস্ব ‘কারখানায়’ তৈরি জিনিস বিদেশে রফতানি হত। মা মমতাজের সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন তিনি। প্রচুর দান করতেন। মক্কা ও মদিনায় প্রতিবছর দান পৌঁছাত তাঁর। আকবরের পথে চলে হিন্দু-ইসলাম সম্প্রীতিতে আস্থা রাখতেন গভীরভাবে।

 Jahanara3

 

প্রিয় ভাই দারাশুকোকে সমর্থন করতেন। ঔরাঙ্গজেবের সঙ্গে যুদ্ধে দারাশুকো নিহত হন। তাঁর খন্ডিত মস্তক পাঠানো হয় সম্রাট শাহজাহানের কাছে। খেলার সাথী, সহপাঠী, সন্তানসম ভ্রাতার ছিন্ন মস্তক দেখেছিলেন জাহানারা।

নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, “তোমার শীতল নিঃশ্বাস আমার মুখমণ্ডলকে শীতলতর করে দিচ্ছে।”

আত্মজীবনী লিখেছিলেন জাহানারা। ১৮৮৬ সালে আগ্রার প্রাসাদে বিদেশীনি তার খণ্ডিত আত্নজীবনী আবিস্কার করেন।আত্নজীবনী পরে বেভারেজ ইংরেজিতে এবং মাখন লাল বাংলায় অনুবাদ করেন।

ভাইয়ে-ভাইয়ে সংঘাত এড়াতে জাহানারা ঔরাঙ্গজেব এবং দারাশুকোর মধ্যে বোঝাপড়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত ঔরাঙ্গজেবের হাতেই মৃত্যু হয় দারার। আগ্রার কেল্লায় বন্দী করেন বৃদ্ধ শাহজাহানকে। জাহানারা পিতার সঙ্গ নেন। নিজের ক্ষমতা, ঐশ্বর্য, ধন সব ত্যাগ করে বাকি জীবন পিতার সেবায়  ব্যস্ত হয়ে যান।

পিতার মৃত্যুর পর ঔরাঙ্গজেব তাঁকে অনুরোধ করেন আগ্রা দূর্গ থেকে দিল্লির দূর্গে ফিরে আসার জন্য। শোনা যায় প্রথমদিকে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন জাহানারা। সহদরা রোশনারা বেগমের সঙ্গে বিরোধ এবং কোনওরকম জটিলতায় যেতে রাজি ছিলেন না। কারণ রোশনারা বেগম তখন অন্দরের সর্বময়কর্তী। কিন্তু ঔরাঙ্গজেব তাঁকে আশ্বস্ত করেন এবং ফিরিয়ে আনেন প্রাসাদে। তাঁকে নতুন উপাধি দেন তিনি। ‘শাহিবাদ-আল-জামানি’। যার অর্থ সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা নারী।

জাহানারা থাকতেন নিজস্ব ভবনে। বই, কবিতা আর সাহিত্যে ডুবে। ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যু হয়। তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁকে দিল্লিতে নিজামুদ্দিনের মাজারের পাশেই গোর দেওয়া হয়।

মা মমুতাজের মতো সুবিশাল রত্ন খচিত সমাধি নয়। নিরাভরণ শ্বেত মর্মরের। একটি মাত্র পান্না ছিল তার গায়ে। সেটিও খোয়া গিয়েছে বহুদিন হল…।  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...