পূর্বসূত্র: ঋষিদের অভিশাপে কৃষ্ণপুত্র শাম্ব লোহার মুষল প্রসব করল। তারই ফলে যদু সম্প্রদায়ের মধ্যে কলহ শুরু হল। গান্ধারীর অভিশাপ সত্য করে নিজেদের মধ্যে লড়াই করে যদুবংশ ধ্বংস হল। বলরাম যোগবলে প্রাণ বিসর্জন করলেন। জরা ব্যাধের তিরের আঘাতে মৃত্যু হল কৃষ্ণেরও। মৃত্যুর আগে কৃষ্ণ জানালেন, পূর্বজন্মে তিনি ছিলেন রামচন্দ্র, আর জরা ছিল বীর বালী। তিনি অন্যায়ভাবে বালীকে বধ করেছিলেন বলে বালীর স্ত্রী তারা অভিশাপ দিয়েছিলেন। তাই এই জন্মে জরার হাতে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত। তবে মৃত্যুর আগে কৃষ্ণ এও জানালেন যে, জরা যেন তাঁকে দাহ করে তাঁর নাভিপদ্ম 'নীলমাধব'রূপে পুজো করে, তাতে একদিন জগতের মঙ্গল হবে। এই উপদেশ দিয়ে কৃষ্ণ মারা গেলেন। তারপর...
সাগরতীরে জ্বলে উঠল চিতা। দাউ দাউ করে কৃষ্ণের নশ্বর দেহ ছাই হয়ে গেল। জেগে রইল শুধু নাভিপদ্ম। চিতা তখনও ধিকি ধিকি জ্বলছে। আগুন সহজে নেভে না। সিন্ধুজলে চিতা নেভাল জরা। তারপর সে অবশেষ-ভস্ম থেকে হাতে তুলে নিল জ্যোতি-স্বরূপ সেই নাভিপদ্ম। যে-ব্যাধের কাছে পশুমাংসই একদা ছিল সাধনার একমাত্র ধন, আজ সেই ব্যাধের কাছে কৃষ্ণের আশীর্বাদী 'নাভিপদ্ম' হয়ে উঠল পরম সম্পদ। শুধু সম্পদ নয়, এ যে তার মোক্ষপথের দিশা! এ তার নিজের, তার একান্ত একার ধন। এ ধন তো জনসমক্ষে রাখা যায় না, কেউ যদি এ-সম্পদ হরণ করে! ছটফট করে উঠল জরা। না না, তাকে পালাতে হবে দ্বারকা ছেড়ে, লোকালয় ছেড়ে। কিন্তু, কোথায়? যেখানে নীলমাধব তাকে নিয়ে যাবেন, সে যে-কোন নির্জন স্থানই হোক না কেন...
রাতারাতি পাথেয় আহার বেঁধে স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে দ্বারকা ত্যাগ করল জরা। খুব একটা গোপনে কাজটা করা গেল না, তাকে জন্মভূমি ত্যাগ করতে দেখে সঙ্গ নিল জ্ঞাতিরা--দুধের শিশুদের পিঠে-কাঁখে বেঁধে, প্রয়োজনীয় তৈজস মাথায় মুটুরি তারাও বাঁধল। কৃষ্ণহীন দ্বারকায় কেই-বা থাকতে চায়! একদিকে ভালোই হল, গোষ্ঠী বেঁধে যাত্রা করলে পথের বাধা আর বাধা হতে পারে না। কিন্তু, কোনদিকে যাবে তারা? চন্দ্র ওঠেন পুব দিকে, সূর্যও ওঠেন--তাই নতুন বাসস্থানের খোঁজে ঠিক হল তারা পুবদিকেই রওনা দেবে। শুরু হল যাত্রা।
কত পথ, কত বন, কত গ্রাম, নগর প্রান্ত পেরিয়ে; হিংস্র জন্তু, হিংস্র মানুষ, নদী-নালা-পাহাড়ের বাধা পেরিয়ে; দিকভ্রষ্ট হতে হতে কয়েক মাসের পথে অনেক সহৃদয় মানুষের ভালোবাসা পেয়ে একদিন তারা পায়ে পায়ে পৌঁছে গেল নির্জন বসতিহীন নীলগিরি পর্বতে। এখানে পৌঁছে তাদের মনে হল, এই সেই স্থান, যেখানে তাদের নিয়তি-নির্দিষ্ট। জরার মনে হল, এই সেই স্থান, যেখানে নীলমাধব অধিষ্ঠিত হতে চান। সারাটি পথ গোপন পেটিকায় রাখা নীলমাধবকে বুকে আগলে নিয়ে এসেছে জরা। তার কাছে কী যে ঐশ্বর্য আছে, এতদিন সঙ্গ করেও সে-কথা ঘুণাক্ষরে কেউ জানল না! জরা জানতেই দিল না!
নীলগিরি পর্বতের পাদদেশে কাঠ-লতা-পাতা দিয়ে তৈরি হল বসতি। রাত্রি হল। চুলো জ্বলল। নতুন বসতিতে প্রথম আহার করল সবাই। এ-যেন দীর্ঘ শ্রান্তি শেষে শান্তির আহার। এতদিন পরে যেন সবাই নিজের ঘরে বিশ্রামের সুযোগ পেল। তাই, চোখে তরিতে আলস্য এল। নির্জন রাত্রির কোলে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। শুধু ঘুম এল না জরার চোখে। নীলমাধবকে এমন স্থানে রেখে আসতে হবে, যার সন্ধান সে ছাড়া আর কেউ কোনদিন পাবে না। কেউ না! ছটফট করে সে অন্ধকারে পায়চারি করতে লাগল। সময় গেল, রাত্রি আরও ঘন হল। তখন সে চকমকি ঠুকে অনেক কসরৎ করে একটা মশাল জ্বালল। তারপর নীলমাধবের পেটিকা নিয়ে গোপনে অতি সন্তর্পণে চলল নীলগিরি পর্বতের অভিমুখে। অনেক চড়াই ভেঙে উঠতে লাগল পর্বতের চূড়ায়। পা ভারি হল, দম কমে এল, তবু সে থামতে পারল না। তার যে গোপন গুহার সন্ধান চাই! হাঁপাতে হাঁপাতে আর মাত্র কয়েক পা এগোতে পারল জরা, তারপর যেই ক্লান্তির অসাবধানতায় একটা আলগা পাথরে পা দিয়েছে--অমনি প্রবল শব্দ করে পাথরটা হড়কে গিয়ে গড়িয়ে পড়ল প্রবল বেগে, জরা টাল সামলাতে পারল না--হাত থেকে ছিটকে গেল মশাল, বুকে চেপে রাখা পেটিকা হাতছাড়া হয়ে হারিয়ে গেল, আর সে গড়িয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল নীচের দিকে, হাতের কাছে বাঁচার মতো কোন অবলম্বন পেল না, পাথরের ক্রমাগত আঘাতে হতবুদ্ধি হয়ে আসন্ন মৃত্যুর বোধও তার লোপ পেয়ে গেল...তারপর...অজ্ঞান হয়ে কখন-কীভাবে যে ছিটকে গিয়ে সে আটকে গেল ছোট্ট একটা ঝোপালো গাছের মাথায়, বুঝতেই পারল না! অনেক...অনেক ক্ষণ পর সে চোখ মেলল। অবস্থাটা বুঝতে একটু সময় লাগল। তারপর প্ৰথমেই হাত উঠে এল বুকে, নীলমাধবের পেটিকা! আমার অমূল্য ধন! কোথায় হারালাম! হে ভগবান! উচাটন মন নিয়ে আহত শরীরটাকে হিঁচড়ে টানতে টানতে গাছ বেয়ে কোনরকমে নীচে নামল সে। কিন্তু, নামতেই সামনে খানিক দূরে সে লতাগুল্মের ফাঁকে এক আশ্চর্য জ্যোতি দেখতে পেল। আশ্চর্যই বটে! যেন বহুবর্ণের বিচ্ছুরণ, যেন অনন্তলোকের আলো! সেই জ্যোতি মুহূর্তে যেন তাকে সম্মোহিত করে ফেলল। গায়ের যন্ত্রণা, মনের উচাটন এক নিমেষে যেন উধাও হয়ে গেল, এল অপার্থিব আনন্দ! সম্মোহিতের মতো সে এগিয়ে গেল জ্যোতির দিকে। লতাগুল্ম ঠেলতেই সামনে এক প্রশস্ত গুহামুখ। সেই গুহার ভেতরে পাথরের বেদী। সেই বেদীর ওপর বিরাজ করছেন--ওই তো তার সাধনার ধন জ্যোতির্ময় নীলমাধব! সম্মোহন ঘুচে আনন্দের আকুল স্রোতে যেন সজ্ঞানে ফিরল জরা। হে প্রভু, আমার নীলমাধব, তোমার আবাস, তুমি নিজেই খুঁজে নিয়েছ! অপার তোমার লীলা প্রভু! অপার তোমার মহিমা! চোখের জলে আকুল জরা ষষ্ঠ অঙ্গে প্রণিপাত করল তার আরাধ্য নীলমাধবকে।
যথাবিহিত নীলমাধবের আরাধনা করে ভোর রাতে পথ চিনে জরা ঘরে ফিরল। না, ঘরের কেউ জানতে পারল না জরার গোপন অভিযান, নীলমাধবের সন্ধান। কেউ না। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে গোপনে সে গুহায় গিয়ে পুজো করে আসতে লাগল, এটাই হয়ে উঠল রীতি। এমনি করেই কাটতে লাগল দিন। নীলমাধবের আশীর্বাদে তার সন্ততিদের বাড়বাড়ন্ত হল। নতুন শবর-বসতির খবর পেয়ে দেশ-দেশান্তর থেকে অনেক শবর এসে তাদের বাসভূমিতে বাস করতে শুরু করল। গড়ে উঠল, শবর রাজ্য। জরা হল, শবররাজ। কতকাল কেটে গেল। তারপর একদিন জরার মৃত্যু হল, মৃত্যুর আগে পুত্রকে গোপনে জানিয়ে দিয়ে গেল নীলমাধবের সন্ধান, তাঁর পুজো-পদ্ধতি। এভাবেই পুত্রানুক্রমে চলতে লাগল এই রহস্যের ধারা। কয়েক পুরুষ কেটে গেল। তারপর একদিন ধারাসূত্রেই নীলমাধবের পুজোর অধিকার পেলেন, জরার উত্তর পুরুষ--বিশ্বাবসু।
ইতিহাস জানে ঈশ্বর স্থাবর নন, তিনি প্রবল জঙ্গম। নীলমাধব সাধারণের পুজো পান না, সান্নিধ্যও পান না। তাই, এভাবে নির্জনে ব্যক্তিগত ঈশ্বর হয়ে থাকতে আর ভালো লাগছিল না তাঁর। তিনি চাইছিলেন ব্যষ্টি থেকে সমষ্টির ঈশ্বর হয়ে উঠতে। নীলমাধবের এই চাওয়া আসলে বিষ্ণুরই চাওয়া। আর সেই চাওয়া থেকেই ঘটনায় যুক্ত হল আরও ঘনঘটা...
উৎকলের রাজা, প্রবল প্রতাপশালী--ইন্দ্রদ্যুম্ন। তাঁর রানি--গুন্ডিচা। রাজার বিপুল সাম্রাজ্য আছে, বাধ্য প্রজা আছে, রাজ্যে সুশাসন আছে, মানুষের অধিকার সুরক্ষিত আছে; কিন্তু, রাজরানির মনে কোন সুখ নেই। আসলে, তাঁদের কোন সন্তান নেই। ফলে, মনে কোন শান্তি নেই। সেই অশান্তি মনে বয়ে বয়ে কতদিন কেটে গেল। তারপর একদিন রাজারানির মনে একটু একটু করে যখন বৈরাগ্যের রঙ ধরতে শুরু করল। মনে হল, এই যে রাজপাট--এ কার জন্য! কার জন্য এসব আগলে থাকা! যে রাজার উত্তরাধিকারী উত্তরপুরুষ নেই, তার সব ছেড়ে বানপ্রস্থে চলে যাওয়াই উচিত! সেখানেই তার শান্তি, সেখানেই তার মুক্তি...
কিন্তু, মুক্তি কোথায়! ভবির মনে তখন যে অন্য লীলার সূচনা হয়ে গেছে! তাই সেদিন রাতে ইন্দ্রদ্যুম্ন যখন নিদ্রায় মগ্ন হলেন, তখন ভগবান বিষ্ণু তাঁকে দেখা দিলেন, স্বপ্নে। বললেন, পুত্র, তোমার বানপ্রস্থের সময় এখনও হয়নি। তোমার হাতে আমার অভ্যুদয়ের কাজ এখনও যে বাকি! শবরের গোপন গুহায় আমি নীলমাধবরূপে নির্বাসিত, তুমি আমায় উদ্ধার করে দেবালয়ে অধিষ্ঠিত করো। আমি একনাথ থেকে যে জগতের নাথ, জগন্নাথ হতে চাই বৎস! তাতে তোমার মঙ্গল হবে, জগতের মঙ্গল হবে!--এই কথা বলেই হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলেন বিষ্ণু। রাজার স্বপ্নও ভেঙে গেল। তিনি ধড়মড় করে উঠে বসলেন। এ যে স্বয়ং ভগবানের আদেশ! অদ্ভুত আনন্দের স্রোত খেলে গেল তাঁর শরীরে! লোমরাশি যেন সজাগ হয়ে উঠল! রানিকে ঘুম থেকে তুলে জানালেন তাঁর সেই অপূর্ব উচ্ছ্বাসের কথা। শুনে রানিরও আনন্দের সীমা রইল না। এ তো আদেশ নয়, এ যে অনুগ্রহ! কিন্তু, উচ্ছ্বাস স্তিমিত হলে রাজার মনে নানাবিধ প্রশ্ন জাগতে লাগল একটি একটি করে। ভগবান আদেশ দিলেন বটে, কিন্তু, পথ তো বলে দিলেন না! পথ কি তাহলে খুঁজে নিতে হবে? হ্যাঁ, ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনোর পথ তো চিরকাল ভক্তকেই খুঁজে নিতে হয়। কিন্তু, কোথায় খুঁজবেন? এতবড় রাজ্য, এতবড় দেশ, বিস্তৃত পৃথিবী! অস্থির হয়ে উঠলেন ইন্দ্রদ্যুম্ন। তড়িঘড়ি সভা ডাকলেন। সব অমাত্য-মন্ত্রী-পুরুত-জ্যোতিষ সবাইকে জানালেন স্বপ্নাদেশের কথা। বললেন, নীলমাধব-অনুসন্ধানের জন্য তাঁর চাই এমন একজন মানুষ; যিনি একইসঙ্গে সাত্ত্বিক, সুজন এবং চতুর।
সবাই বেশ ভাবনায় পড়ে গেলেন--এমন বিরলগুণের মানুষ কই, কাউকে তো চোখে পড়ে না! সবাই ভাবনায়, সবাই চুপ, রাজা অস্থির! তাহলে কি কোন উপায়ই নেই! নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রথম কথা বললেন রাজপুরোহিত--মহারাজ যেমন চাইছেন, তেমন একজনই আছে এ-রাজ্যে! রাজা ব্যগ্র হলেন, কে? কে সে? বলো রাজপুরোহিত বলো তার নাম! রাজপুরোহিত বললেন, মহারাজ, সে আমার ভ্রাতা, বিদ্যাপতি।
রাজা আদেশে কী না হয়! তিনি নীলমাধব উদ্ধারের আদেশ দিলেন বিদ্যাপতিকে, আর দিলেন একটি দ্রুতগামী ঘোড়া। আর অসংখ্য রত্নমুদ্রা পাথেয়। বিদ্যাপতি বিবাহিত। তাই স্ত্রীর কাছে বিদায় নিয়ে পাড়ি দিলেন এক অনিশ্চিত-অনির্দিষ্টকালের পথে। এই পথ কীভাবে ঘটনার ঘনঘটা পেরিয়ে তাঁকে জগন্নাথের চরণে পৌঁছে দেয়, তার জীবনকে ওলট-পালট করে দেয়--সে কাহিনি বলব আগামিকাল, চতুর্থ পর্বে।