পূর্বসূত্র : শতপুত্র হারিয়ে কৃষ্ণকে গান্ধারী অভিশাপ দিলেন যে, ছত্রিশ বছর পর যদুবংশ ধ্বংস হবে। কৃষ্ণ দ্বারকায় ফিরলেন। সুখে ছত্রিশ বছর কাটল। তারপর একদিন দেবর্ষি নারদ এবং মহর্ষি কণ্ব ও বিশ্বামিত্র দ্বারকায় কৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। তখন কৃষ্ণের পুত্র শাম্বকে গর্ভবতী নারী সাজিয়ে যুবকের দল তিন ঋষির সঙ্গে অশিষ্ট তামাশা করে বার বার জানতে চাইল যে, গর্ভিনী কেমন সন্তান প্রসব করবে? ঋষিরা রেগে অভিশাপ দিলেন যে, শাম্ব লোহার মুষল প্রসব করবে, তাতেই যদুবংশ ধ্বংস হবে। ঋষির কথা সত্যি করে শাম্ব লোহার মুষল প্রসব করল। অমনি শুরু হল যাদবদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব। শুরু হল হানাহানি। তাতে কৃষ্ণের পুত্র ও আত্মীয়রা সবাই মারা গেল। শোকে বলরাম যোগবলে প্রাণত্যাগ করলেন। শোকগ্রস্ত কৃষ্ণ আনমনে বনের লতাবিতানে বসতেই একটা তির ছুটে এল তাঁর দিকে এবং তাঁকে বিদ্ধ করল। তারপর...
লতাবিতানে আনমনে বসে ছিলেন কৃষ্ণ। কিন্তু, অতর্কিতে তাঁর পিঠে এসে লাগল তির, এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেলল বুক। ভাবনার সুতো ছিঁড়ে তিনি পড়ে গেলেন মাটিতে। কৃষ্ণ শোকে এতটাই বিহ্বল ছিলেন যে, অতর্কিত এই আঘাতেও তাঁর মুখ দিয়ে কোন আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল না। কিন্তু, রক্তে ভেসে যেতে লাগল ধরণীর ধুলো। শুরু হল প্রাণঘাতী যন্ত্রণা। চরাচর ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল। চোখের সামনে জালের মতো একটা একটা করে পড়তে লাগল অন্ধকারের পর্দা। তখনই তিনি দুর্দান্ত একজোড়া পায়ের শব্দ পেলেন। অনেক কষ্টে ঘাড় ফিরিয়ে সেদিকে তাকালেন। দেখলেন, প্রায় ঝাপসা অবয়বের মতো, এক ব্যাধ মহা উৎসাহে ছুটে আসছে তাঁর দিকে। এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই লতাবিতানের বাধা টপকে সে একেবারে হাজির হল কৃষ্ণের কাছে হাজির। আর তারপরই দারুণ আপশোশে ব্যাধ চিৎকার করে উঠল, নিজের চোখকেই যেন সে বিশ্বাস করতে পারল না, মহারাজ কৃষ্ণ! এ কি করে সম্ভব! হায়, এ আমি কি করলাম! বিলাপ করতে করতেই সে মাটিতে বসে পড়ল। তারপর কৃষ্ণের লুটনো মাথা কোলের উপর তুলে নিল। কৃষ্ণ অতিকষ্টে জল চাইলেন। তখন কাঁধে ঝোলানো হরিণের চামড়ার ভৃঙ্গার থেকে পরম যত্নে কৃষ্ণকে জল খাইয়ে দিল সে। কৃষ্ণের মুখে লেগে থাকা ধুলো মুছিয়ে দিল। পলাশ পাঁপড়ির মতো দুই ঠোঁট ভিজিয়ে দিল। কৃষ্ণের মৃত্যুযন্ত্রণা দেখে তার দু'চোখ বেয়ে ঝরে পড়তে লাগল অবিরল অশ্রুধারা। নিজেকে দোষ দিয়ে সে বার বার বলতে লাগল, হে মহারাজ, আমি পাপিষ্ঠ ব্যাধ জরা, আমায় ক্ষমা করুন। লতাবিতানের ফাঁকে আপনার বস্ত্রের ঝলক দেখে আমার হরিণ ভ্রম হয়েছিল প্রভু। হে ঈশ্বর, আমি কেন ভ্রমের বশে তির ছুঁড়লাম! আমায় ক্ষমা কর প্রভু, আমায় ক্ষমা কর!--কৃষ্ণের হাত ধরে মিনতি করে অঝোরধারায় কাঁদতে লাগল জরা। তখন কৃষ্ণের মৃত্যুক্লিষ্ট মুখেও ফুটে উঠল আপশোশের যন্ত্রণা। অতি কষ্টে তিনি বললেন, এভাবে বলো না জরা, বরং তুমি আমাকে ক্ষমা করো, তোমার কাছেও যে আমার গতজন্মের ক্ষমাঋণ রয়ে গেছে! তুমি যে ভুল করেছ, সেই ভুলের শুরু তো আমার থেকেই...তোমার হয়ত মনে নেই, কিন্তু, এই মৃত্যুকালে যেন সব স্পষ্ট মনে পড়ে যাচ্ছে আমার...
তখন ত্রেতা যুগ। অযোধ্যার যুবরাজ রাম। পিতার আজ্ঞায় পত্নী সীতা, ভ্রাতা লক্ষ্মণকে নিয়ে তিনি বনবাসী। জঙ্গলের মাঝে কুঁড়ে বাঁধলেন। কিন্তু, দুই ভাইয়ের অনুপস্থিতির সুযোগে লঙ্কার রাক্ষসরাজ রাবণ একদিন সেখান থেকে ছলেবলে সীতাকে হরণ করে নিয়ে গেলেন। কোথায় হারালেন সীতা, কোথায় গেলেন; ফিরে এসে দুই ভাই কিছুই জানতে পারলেন না! প্রথমে বিশ্বাস করতে পারলেন না যে, ঘরে সীতা নেই। না, সত্যিই ঘরে নেই! তাহলে, কাছেপিঠে কোথাও গেছেন হয়ত, এক্ষুনি ফিরবেন! কিন্তু, সময় গেল, সীতা ফিরে এলেন না। দুইভাই যখন বুঝলেন যে সত্যই সীতা হারিয়েছেন, তখন দুজনের পাগল পাগল অবস্থা হল। শুরু করলেন খোঁজ। খবর পেলেন, রাবণ তাঁকে হরণ করেছেন। দুজনের মাথায় হাত--কোথায় লঙ্কা, কোথায় রাবণ--সেখান থেকে সীতাকে উদ্ধার করা হবে কেমন করে! তাঁরা যখন দিশাহারা, তখন তাঁদের সঙ্গে আলাপ হল, ভক্ত হনুমানের। সব শুনে তিনি বললেন, একমাত্র বানররাজ ও তাঁর সেনার সাহায্যেই সমুদ্রপারের দেশ লঙ্কায় যাওয়া সম্ভব, সীতা মাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু, কোন বানররাজ তাঁদের সহায়তা করবেন? কেনই বা করবেন? হনুমান স্মিত হেসে বললেন, করবেন। বানররাজ সুগ্রীব। তিনি নিজেই এখন বিপদে আছেন। তাঁকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেই তিনি আমাদের সহায়তা করবেন। আর সেই বিপদ থেকে প্রভু রাম একমাত্র আপনিই তাঁকে উদ্ধার করতে পারেন...। রামচন্দ্র আশার আলো দেখে আগ্রহী হলেন। উৎসুক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, বিপদ? কীসের বিপদ? তখন হনুমান বলতে শুরু করলেন...
বেশ কিছু বছর আগের কথা। কিস্কিন্ধ্যার বানররাজ বালী আর তাঁর ভাই সুগ্রীব, দুজনেই দারুণ বীর; তাঁদের একদিন যুদ্ধে আহ্বান করল মায়াবী নামের এক রাক্ষস। দুই ভাই তাড়া করলেন মায়াবীকে। মায়াবী পর্বতের এক গুহায় গিয়ে প্রবেশ করল। বালী তার পিছু নিলেন আর সুগ্রীব রইলেন গুহার মুখে পাহারায়। বহুবছর কেটে গেল। মায়াবী বা বলী কেউই গুহা থেকে বেরিয়ে এলেন না। কিন্তু, হঠাৎ একদিন গুহার ভেতর থেকে নদীর হড়পা স্রোতের মতো রক্তের স্রোত বেরিয়ে এল। সুগ্রীব তাই দেখে হতবুদ্ধি হলেন। ভাবলেন, মায়াবীর সঙ্গে যুদ্ধে নির্ঘাত দাদা বালীর মৃত্যু হয়েছে! তিনি বুঝলেন না সুঝলেন, শোকে মুহ্যমান হয়ে মায়াবী যাতে বেরিয়ে আসতে না-পারে সেজন্য গুহার মুখে পাহাড়প্রমাণ পাথর চাপা দিয়ে রাজপুরীতে ফিরলেন এবং রাজা হয়ে রাজ্য শাসন করতে লাগলেন। বেশ চলছিল। কিন্তু, একদিন ঘটে গেল সেই অবশ্যম্ভাবী ঘটনাটা।
আসলে, বালী মারা যাননি। তিনি মায়াবীকে বধ করে যখন গুহার মুখে ফিরলেন, তখন পাহাড়-পাথরে তা বন্ধ। সুগ্রীবের নাম ধরে কতবার ডাকলেন, কেউ সাড়া দিল না। তখন অনেক বলপ্রয়োগ করে অনেক দিনের চেষ্টায় একটু একটু পাহাড় সরিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে এলেন। দেখলেন বাইরে কোত্থাও সুগ্রীবের চিহ্নমাত্র নেই। মনে একটা খটকা লাগল! রাজসভায় ফিরলেন, দেখলেন সুগ্রীব সিংহাসনে! দুয়ে দুয়ে চার করতে দেরি হল না। তাঁর মাথা গরম হয়ে গেল! সমস্তটাই তাহলে সুগ্রীবের চক্রান্ত! দারুণ হুঙ্কার ছেড়ে তখনই চক্রান্তকারীকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন বালী। সুগ্রীব তাঁকে বোঝাতে চাইলেন যে, এটা নেহাতই একটা ভুল বোঝাবুঝি; কিন্তু বালী তাঁর কথায় কর্ণপাত করলেন না। সুগ্রীব প্রহৃত হলেন, প্রাণ বাঁচাতে কোনরকমে পালালেন। সুগ্রীব বীর, কিন্তু, বালীকে সম্মুখ সমরে পরাজিত করার সাধ্য কারোরই নেই। এমনকি শ্রীরামেরও নেই। গোঁয়ার বালীকে বুঝিয়ে লাভ নেই। তিনি প্রাণ থাকতে বুঝবেন না। সুগ্রীব প্রাণের ভয়ে গুহাকন্দরে লুকিয়ে আছেন, তাই তাঁকে বাঁচাতে বালীকে হত্যাই একমাত্র পথ। আর সুগ্রীবকে বাঁচানোই হল, এখন সীতাউদ্ধারের একমাত্র পথ।
সবই বুঝলেন রামচন্দ্র। তবুও যুগপৎ দ্বন্দ্ব ও প্রশ্ন জাগল মনে। বালীকে তো তিনি হত্যা করতে পারেন না! বালীর সঙ্গে সুগ্রীবের শত্রুতা থাকতে পারে, তাঁর সঙ্গে তো নেই! তাহলে? এ এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। আর এ-কাজে সহায়তা করতে কূটনৈতিক বুদ্ধি নিয়ে এগিয়ে এলেন হনুমান, তিনি জানালেন : যখন সুগ্রীবের সঙ্গে রামচন্দ্রের সখ্যতা হবে, তখন সখার শত্রু তাঁরও শত্রু হবে। সুতরাং, এই যুক্তিতে বালীকে হত্যা করাটা অন্যায় হবে না। আর সম্মুখ সমর হবে কেবল বালী এবং সুগ্রীবের। সুগ্রীবের জীবন বিপন্ন দেখলে সখা হিসেবে রামচন্দ্র বালীকে হত্যা করবেন আড়াল থেকে। সমরনীতিতে জয়ের জন্য কোনকিছুই অসিদ্ধ নয়!
হনুমানের পরামর্শে স্থির হওয়া ছাড়া রামচন্দ্রের আর কোন উপায় ছিল না। তিনি মনস্থির করলেন। তখন হনুমান তাঁদের নিয়ে গেলেন সুগ্রীবের গোপন আস্তানায়। আলাপ হল, মিত্রতা হল। দিলেন পরস্পর সাহায্যের আশ্বাস। এবং, তারপরের ঘটনা খুব দ্রুত ঘটে গেল। রাম, লক্ষ্মণ ও হনুমানের পরামর্শে সুগ্রীব বালীকে যুদ্ধের জন্য উত্তেজিত করে ডেকে আনলেন নির্জন জঙ্গলে। শুরু হল দ্বৈরথ। শুরু হল ছলনার লড়াই। লড়াই তো নয়, এ হল পেতে রাখা ফাঁদ! যে ফাঁদে ধরা দিলেন বালী। বীর বালী! তিনি যখন সুগ্রীবকে হারিয়ে হত্যা করতে প্রায় প্রস্তুত, এমন সময় পিছন থেকে আড়াল থেকে চোরের মতো তির মেরে তাঁকে হত্যা করলেন রাম!
বালীর প্রতি এই অন্যায়, ধর্মযুদ্ধের নামে বানরসমাজ মেনে নিল, বালীপুত্র অঙ্গদ মেনে নিল; কিন্তু, বালীর স্ত্রী তারা মেনে নিলেন না! তিনি মৃত স্বামীর শরীর ছুঁয়ে অভিশাপ দিলেন রামকে--এই অন্যায়ের, এই অপঘাতের প্রতিশোধ নেবেন স্বয়ং বীর বালী! দ্বাপর যুগের জন্মান্তরে জঙ্গলবাসী রামচন্দ্রের মৃত্যু কিছুতেই বীরের মতো হবে না, হবে পশ্চাৎঘাতে, এমনই তিরের আঘাতে, বনবাসী সামান্য ব্যাধের হাতে!
পূর্বজন্মচারণা থেকে বাস্তবে ফিরলেন কৃষ্ণ। মৃত্যুর করাল ছায়া আরও ঘনীভূত হয়েছে তাঁর মুখে। মাথা ব্যাধের কোলে। ঠোঁটে স্মিত হাসি। ক্ষীণস্বরে বললেন, হে ব্যাধ তুমি সেই ত্রেতা যুগের বালী, আর আমি রামচন্দ্র। আজ তারার অভিশাপ পূর্ণ হল। তোমার-আমার রক্তঋণ শোধ হল। কিন্তু, একটা কথা মনে রেখো, শুধুমাত্র প্রতিহিংসা নিবৃত্তির জন্যই আমাদের জন্ম হয় না। আমাদের জন্মের মধ্যে থাকে প্রভূত মঙ্গলের পদধ্বনি। তাকে পথ করে দেওয়াই তোমার আমার কাজ। আমি মরে গেলে তুমি নিজের হাতে আমার পার্থিব শরীর দাহ করো। চিতার আগুনে নাভিপদ্ম সহজে পোড়ে না, আমারও পুড়বে না। তাকে তুমি রক্ষা করো, পুজো করো নীলমাধব রূপে। কলি যুগে নীলমাধবের জ্যোতিতে তোমারসূত্রেই রচিত হবে জগৎমঙ্গলের পথ।--জরাকে এভাবেই শেষ উপদেশ দান করে দেহ ত্যাগ করলেন কৃষ্ণ। অদ্ভুত এক রোমাঞ্চে কেঁপে উঠল জরার শরীর--আমায় এ কোন অনাগত দিনের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে গেলে প্রভু! কোন মঙ্গলের আলোয় আমায় ভরিয়ে দিলে! তার চোখে শোকের অশ্রু, রোমকূপে পুলকের স্বেদ! সামনে বর্তমানের পথ অতীত ঘুরে এগিয়ে চলেছে ভবিষ্যতের দিকে। সেই পথেই অপেক্ষা করছে অপাররহস্যময় জগন্নাথদেবের আবির্ভাব কাহিনি। সেই কাহিনি বলব আগামিকাল, তৃতীয় পর্বে।
পাদটিকা : শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর উপাখ্যানে তির ছোঁড়ার সময় জরার বিভ্রমের দু'রকম বর্ণনা পাওয়া যায়। এক মতে, জরা কৃষ্ণের আলতা পরা পা পাখি ভেবে তির চালিয়েছিল। আর অন্য মতে, কৃষ্ণের গায়ের কাপড় লতাঝোঁপের ফাঁক দিয়ে হরিণের দেহ বলে ভ্রম হয়েছিল। আমি দ্বিতীয়টি গ্রহণ করেছি পূর্বাপর সঙ্গতি স্থাপনের জন্য।