কোয়ারেন্টাইনে জগন্নাথদেব

'কোয়ারেন্টাইন' শব্দটি করোনাকালে আমাদের কাছে বহুল প্রচলিত। দিকে দিকে সরকারি তরফে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার পজেটিভ কেস মানেই সেই জায়গা কে কোয়ারেন্টাইন করে রেড জোন ঘোষণা করে দেওয়া। প্রথমের দিকে সবাই যখন আতঙ্কিত তখনতো ভিন রাজ্য বা ভিন দেশ থেকে কেউ আসা মানেই ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইন। সচেতন নাগরিকরা একটু গা গরম হলেই হোম কোয়ারেন্টাইন। এক ছাদের তলায় থেকে আলাদা ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে করোনাকালে কোয়ারেন্টাইন নিয়ে ক্যাচালের শেষ নেই। তবে মজার কথা করোনা নয় কস্মিনকাল থেকে এই ব্যবস্থা চলে আসছে শুধু এই ইহজগতের মানুষই নয় জগতের নাথ জগন্নাথ কোয়ারেন্টাইনে থাকেন তারও কোয়ারেন্টাইন দশা চলে। বৈদিক যুগেও কোয়ারেন্টাইনের কথা শোনা যায়। তাই বলাই যায় পুরাকাল হয়ে আজকের এই করোনাকালে কোয়ারেন্টাইনের চল চলছে ভালোই। তবে পুরীর জগন্নাথ দেবকে নিয়ে এই কোয়ারেন্টাইন কথা শুনে মনে হয় উৎসব যেন সবাইকে মিলিয়ে দেয়। মিলিয়ে দেওয়ার এই মিলন যজ্ঞে জাগতিক সুখ দুঃখ থেকে দেবতা দূরে থাকেন না মানুষ ও দেবতা একাকার হয়ে যায়।

 কথিত আছে, জৈষ্ঠ্য মাসের প্রবল গরমে যখন সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত তখন দেবতাকে প্রাণের আরাম দেওয়ার জন্য স্নানের ব্যবস্থা করা হয় সেই উৎসবের নাম স্নানযাত্রা। 'স্বর্ণকুয়ো' থেকে একশো আট ঘড়া জল নিয়ে এসে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা কে স্নান করানো হয়। সেই দিন সন্ধ্যাবেলা স্নানপর্বের সমাপ্তির পর জগন্নাথ ও বলভদ্রকে গণেশের রূপে সাজানোর জন্য হস্তীমুখ-বিশিষ্ট মস্তকাবরণী পরানো হয়। জগন্নাথের এই রূপটিকে বলা হয় 'গজবেশ'। যাই হোক অতিরিক্ত স্নান এর ফলে জগন্নাথের জ্বর আসে সেই কারণে তখন আর তিনি সর্বসমক্ষে থাকেন না চলে যান কোয়ারেন্টাইনে, যে ঘরে থাকেন তাকে বলে 'নিরোধন গৃহ'। আধুনিক ভাবে একে হোম আইসোলেসন বলা যেতে পারে। শরীর খারাপ হয়েছে তাই সাথে সাথে শুরু হয় নানা রকম চিকিৎসা। কয়েকজন পুরোহিত বৈদ্যের মত সেবা করেন। সাধারণ রাজসিক ভোগ প্রসাদ বন্ধ হয়ে যায়। রত্ন জড়ানো পোশাক ছেড়ে পড়ানো হয় সাদা সুতির বস্ত্র। ফল, ফলের রস,তরল পদার্থ জাতীয় দুধ ও হালকা খাবার ভোগে দেয়া হয়, সঙ্গে দেওয়া হয় কিছু আয়ুর্বেদিক ওষুধ। এটাকে ইমিউনিটি বুস্ট করার প্রাথমিক পর্যায়ও বলা যেতে পারে। উড়িয়া মঠ থেকে ফুলেরি তেল আসে যা দিয়ে হালকা মালিশ করা হয়, যাতে কিছুটা ব্যথার উপশম হয়। রক্ত চন্দন ও কস্তুরীর প্রলেপ দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টাও চলতে থাকে। চব্বিশ ঘন্টা ধরে নিরবিচ্ছিন্ন সেবা চলতে থাকে বলে একে বলা হয় 'অনবসর'। অনবসর মানে নেই অবসর (সুযোগ)। পুজো করবার সুযোগ নেই। মন্দির থাকে বন্ধ। প্রভুকে দর্শন নিষেধ। স্নানপূর্ণিমা পরবর্তী কৃষ্ণা প্রতিপদ হতে অমাবস্যা পর্যন্ত চলে এই অনবসর। অনবসরের সেবাতে সাধারণ মান বজায় রাখা হয়। যেন একটা শোকের আবহ। ঘরটাও কেমন অন্ধকার থাকে। শুধু একটা মাটির প্রদীপ জ্বলে। তখন জগন্নাথকে শুধু শ্বেত পুষ্প নিবেদন করা হয়। ষষ্ঠী হতে নবমী অবধি পুরানো প্রলেপ তুলে নিয়ে পালিশ করে নতুন করে রেজিনের প্রলেপ (ওড়িয়াতে ঝুনা) দেওয়া হয়। একে বলে 'ওসুয়া লাগি'।
দশম দিনে হলুদ হরিতকী বহেড়া লবঙ্গ ইত্যাদি দিয়ে জড়িবুটি জলের সঙ্গে নরম মিষ্টি বানিয়ে তাঁকে খেতে দেওয়া হয়। তারপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন রকম স্বাস্থ্যকর খাবার দেওয়া হতে থাকে।

jagannath


একাদশীর দিন বিগ্রহকে রক্তিম বস্ত্র প্রদান করার রীতি পালিত হয়। সঙ্গে চন্দন, কেশর ও কর্পূর নিবেদন করা হয়।
দ্বাদশীর দিন জগন্নাথের মূল সেবক মহারাজা গজপতির কাছে খবর যায়, প্রভু আর তাঁর ভ্রাতা-ভগ্নী সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
এরপর ত্রয়োদশীতে 'ঘনলাগি' নামে একটি রীতি পালিত হয় , যাতে বিগ্রহকে দড়ি দিয়ে পেঁচানো হয়।
চতুর্দশীর দিন জগন্নাথের বিগ্রহের রঙের কাজ হয়। 'দত্ত মহাপাত্র' নামের সেবকরা এ কাজ করেন।

 ১৪ দিনের মাথায় দেবতা অনেকটাই তরতাজা হয়ে ওঠেন। ঠিক যেভাবে ডাক্তাররা বাড়িতে থেকে হোম আইসোলেশনের মধ্য দিয়ে করোনা চিকিৎসার কথা বলছেন। তবে এই পুরো সেবাভারের দায়িত্ব থাকে সবর ও অন্ত্যজ শ্রেণী সম্প্রদায়ের মধ্যে।
জ্বরলীলা কাটিয়ে জগন্নাথ দেব সুস্থ হয়ে আবার গর্ভগৃহে ফিরে আসেন ঠিক ১৪ দিন পর। অপদেবতার নজর যাতে না লাগে সেই জন্য জগন্নাথকে ভালবেসে দয়িতারা বিগ্রহের হাতে মাদুলির মত করে নানা রকম লতা শিকড়ের মূল বেঁধে দেন। হিসেব করলে দেখা যায় স্নানযাত্রার পর থেকে ঠিক ১৪ দিন পরেই রথযাত্রার আয়োজন করা হয়। মাঝখানের এই দিনগুলো স্বাস্থ্যসম্মত বিধিনিষেধ সঠিক ভাবেই চলে, তাতেই জগন্নাথ দেব  সুস্থ-সবল হয়ে উঠেন। এরপরের দিন মানে অমাবস্যার দিন হয় 'নয়নকল বা নেত্র উৎসব’। বলা হয় এদিন প্রভু তাঁর নয়ন উম্মিলন করেন। বস্তুত এদিন প্রভুর গোলাকার নয়ন রং দিয়ে আঁকা হয়।
শুক্লা প্রতিপদে নতুন রঙে নতুন সাজে নবযৌবন লাভ করেন জগন্নাথ। শেষ হয় অনবসর কাল।
তারপর জগন্নাথ আবার জগতের নাথ হয়ে রথে চড়ে বসেন। জনসাধারণের দড়ির টানে রথ গড়াতে থাকে সামনের দিকে তার আপন মহিমা বলে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...