পূর্বসূত্র: কৃষ্ণের নাভিপদ্ম নীলমাধবরূপে বহুপুরুষ ধরে গোপনে পুজো করছিলেন বিশ্বাবসু। উৎকল রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে নীলমাধব স্বপ্নে জানালেন যে, তিনি ব্যক্তিগত ঈশ্বর নয়, সমষ্টির ঈশ্বর হিসেবে জগন্নাথরূপে প্রতিষ্ঠা পেতে চান। দেবতার আদশে রাজা বিদ্যাপতি নামের এক ব্রাহ্মণকে নীলমাধবের অনুসন্ধানে পাঠালেন। ঘটনাচক্রে বিদ্যাপতি বিশ্বাবসুর গৃহে আশ্রয় পেলেন এবং নীলমাধবের কথা জানতে পারলেন। এবার নীলমাধবের গুপ্ত মন্দিরের পথ চিনে নিতে এক গোপন পরিকল্পনা করলেন। তারপর...
বিশ্বাবসু অবাক হয়ে গেলেন ললিতার কথা শুনে। ক্ষুব্ধও হলেন। শবর কন্যার স্বাধীনতা আছে স্বামী নির্বাচনের। কিন্তু, স্বজাতি ছেড়ে ললিতা যে বিদ্যাপতির মতো অর্বাচীন কোন জাতি-বর্ণের মানুষকে স্বামী হিসেবে নির্বাচন করবে--এ যেন তাঁর বিশ্বাস হয় না, এমন শিক্ষা তো তিনি কন্যাকে দেননি! উভয়ের সংস্কৃতি আলাদা, সমাজনীতি আলাদা--দুজনে মিলবে কীভাবে!
ললিতা বিশ্বাবসুর দিকে সতেজ তাকাল। স্পষ্ট বলল, 'আমরা তো মিলিত হয়েই গেছি পিতা। ভালোবাসায়। এখন শুধু তোমার অনুমতির অপেক্ষা। তুমি যদি অনুমতি না-দাও, তাতে এই শবরকুলের স্বাধীন সমাজনীতি রক্ষিত হবে তো, পিতা? সেই নীতির রক্ষক হিসেবে, শবরজাতির অধিপতি হিসেবে তোমার খ্যাতি অমলিন থাকবে তো, পিতা?'
কন্যার প্রত্যুত্তরে বিবাহের অনুমতি দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় রইল না বিশ্বাবসুর। তবে, মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা শূন্যতা জমে গেল। তাঁর পুত্র নেই। ভেবেছিলেন, কোন বীর শবরের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিয়ে তাকেই পুত্রের মর্যাদা দেবেন। নীলমাধবের উত্তরপূজারি হিসেবে তাকে নিযুক্ত করে বলে দেবেন কুলদেবতার গূঢ় রহস্য। কিন্তু, এই বিজাতীয় বিদ্যাপতিকে তিনি এই পদে কখনই বরণ করতে পারবেন না। বিজাতীয়ের হাতে কন্যা দিলেও, কুলদেবতাকে তার হাতে তুলে দিতে কখনো পারবেন না, কখনই না!
পিতা-পুত্রীর এই টানাপোড়েনের সমাপন যখন হল, বিশ্বাবসুর মনে একে একে যখন ভাবনার পরত জমতে লাগল; তখন আড়াল থেকে দু'জন হাসলেন--এক, বিদ্যাপতি; দ্বিতীয়, নীলমাধব। আসলে, ললিতার চেতনার সুতো এখন বিদ্যাপতির হাতে। তাই তাঁর নির্দেশেই ললিতা পিতার কাছ থেকে বিবাহের অনুমতি আদায় করে ছাড়ল। এতে তাঁর গোপন অভিসন্ধি পূর্ণতার পথ খুঁজে পেল। তাই তিনি হাসলেন। কিন্তু, নীলমাধব কেন হাসলেন, তিনিই জানেন!
বিবাহে দেরি হল না। বিদ্যাপতি ও ললিতার আগ্রহে শীঘ্রই একদিন বিবাহ সম্পন্ন হল। সমস্ত শবরসমাজ মেতে উঠল সেই আনন্দ উৎসবে। রাত বাড়ল। ওদিকে বাসরঘরে তখন বিদ্যাপতি আর ললিতা। সেই একান্ত মুহূর্তে বিদ্যাপতি গোপন অভিসন্ধির পথে সিদ্ধি পেতে আরও একটু ছলনার আশ্রয় নিলেন। বনফুল, বৈচি আর পাখি-পালকের অলঙ্কারে সজ্জিতা নববধূ ললিতা। তার আঙুলে বিদ্যাপতি নিজের নামাঙ্কিত রত্নখচিত অঙ্গুরী পরিয়ে দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, 'পছন্দ হয়েছে? তুমি খুশি তো, ললিতা?' ললিতা রাজকন্যা হয়েও কখনও বহুমূল্য রত্নালঙ্কার পরা তো দূরের কথা, স্পর্শ করারও সুযোগ পায়নি। আর স্বামীর দেওয়া এ উপহার, তার পছন্দ হবে না! না হয়ে পারে? জানাল, হয়েছে বৈকি, খুব পছন্দ হয়েছে। সে সরল মনেই খুশির কথা প্রকাশ করল। এবার সুযোগ বুঝে বিদ্যাপতি আসল প্রসঙ্গে এলেন। বললেন, 'এ-বার তোমারও তো আমাকে কিছু দিতে হয় ললিতা, যাতে আমি খুশি হই!' ললিতা যেন লজ্জিত হল, 'হ্যাঁ, তাই তো...বলো তুমি কী পেলে খুশি হবে, গুঞ্জা মালা? নাকি, পালকের মুকুট?' 'উঁহু, ওসব না...আমি যে নীলমাধবের কৃপায় প্রাণ ফিরে পেয়েছি, তাঁকে একবার দর্শন করতে চাই। সাক্ষাৎ প্রণাম করতে চাই। তাহলেই আমি খুশি হব।'--ললিতার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে বললেন বিদ্যাপতি। এ-কথা শুনে ললিতা ম্লান হল। বলল, 'দেখি পিতাকে বলে...।'
পরদিন ললিতা যখন বিশ্বাবসুর কাছে বিদ্যাপতিকে নীলমাধব দর্শন করানোর আবদার করল, তা শুনে হয়রান হয়ে গেলেন বিশ্বাবসু! এ কী করে হয়! তিনি যতদিন বেঁচে আছেন, সুস্থসমর্থ আছেন; ততদিন তো অন্য কারও নীলমাধব দর্শনের অধিকার নেই। না, এ হয় না! ললিতা যখন শত অনুরোধেও পিতাকে রাজি করাতে পারলেন না, তখন আসরে নামলেন স্বয়ং বিদ্যাপতি। তিনি সহসা বিশ্বাবসুকে এসে বললেন, 'মহারাজ, আমাকে আজ্ঞা দিন, আমি একাকী স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে চাই!' এ-কথা শুনে বিশ্বাবসু হতবাক--'একাকী! এ কী বলছ পুত্র?' বিদ্যাপতি বললেন, 'হ্যাঁ, একাকী! যে-গৃহে জামাতার ইচ্ছের মর্যাদা রক্ষিত হয় না, সে-গৃহের অন্ন বা কন্যা কোনকিছুই গ্রহণীয় নয়! আমি শুধু শ্বশুরকুলের ইষ্ট, আমার প্রাণরক্ষাকারী ঈশ্বরকে দর্শনের অভিলাষ জানিয়েছিমাত্র--মানছি, তাঁর অবস্থান জানা কুলনিয়মবিরুদ্ধ, আমার সে নিয়ম ভাঙার কোন অভিপ্রায়ও নেই। আপনি যদি আমার ইচ্ছেকে সম্মান জানাতে চান, তাহলে আমার দুই চক্ষু বস্ত্রখণ্ডে বেঁধে আমায় নিয়ে চলুন--ঈশ্বরদর্শনের সুযোগ দিয়ে আমায় কৃতার্থ করুন। নতুবা, চরম সিদ্ধান্ত নিতে আমি বাধ্য হব!' বিশ্বাবসু বিদ্যাপতির এই রুক্ষ্ম রূপ দেখে অবাক হয়ে গেলেন। অনুরোধ নয়, উপরোধ নয়, এ যে চরম হুঁশিয়ারি! তিনি রাজা ঠিকই, তবুও যে তিনি কন্যার পিতা! কন্যার সুখের কথা ভেবে তিনি বেপরোয়া হতে পারেন না। পারলেন না হতে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, 'বেশ, আজ রাতে প্রস্তুত থেকো, তোমার অভিলাষ পূর্ণ হবে।' বিশ্বাবসু চলে গেলেন। বিদ্যাপতির ঠোঁটে ফুটে উঠল যুদ্ধজয়ের স্মিত হাসি।
রাত্রি তখন দ্বিপ্রহর। বিদ্যাপতির দুই চোখ ভালো করে বেঁধে ফেলা হল বস্ত্রখণ্ডে। তারপর বিশ্বাবসু এক হাতে নীলমাধবের অর্ঘ্যসামগ্রী, অন্য হাতে বিদ্যাপতিকে ধারণ করে এগিয়ে চললেন নীলগিরি পর্বতের দিকে। বিশ্বাবসু বিদ্যাপতিকে প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন, তাই বিদ্যাপতি প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। কোঁচড়ে ফুটো করে বেঁধে রেখেছিলেন সর্ষের থলি, সেই থলি থেকে সমস্ত রাস্তা এখন সর্ষে পড়তে পড়তে চলেছে। ক'দিন পর এই সর্ষে থেকে গাছের জন্ম হবে, তখন সেই গাছের রেখা ধরে পথ চিনে নিতে কোন অসুবিধেই হবে না। অসুবিধে হবে না নীলমাধব উদ্ধারে!
অনেকক্ষণ হাঁটার পর, অনেক চড়াই-উতরাই ভাঙার পর বিশ্বাবসু একসময় থামলেন। বিদ্যাপতির চোখের বাঁধন খুলে দিলেন। তখন, গুহার অন্ধকারে চোখের সামনে দেখতে পেলেন--সেই পরম ইষ্ট, জ্যোতির্বলয় নিয়ে বিরাজমান রয়েছেন তাঁর অভীষ্ট নীলমাধব। সেই অপূর্ব জ্যোতি দেখে বিদ্যাপতির মনে এক অভূতপূর্ব আনন্দের উদয় হল। হৃদয় যেন পূর্ণ হয়ে গেল। মনে হল, আহা, কী দেখলাম, এ জীবন ধন্য হয়ে গেল! চোখের জলে নয়ন ভাসল। আভূমি নত হয়ে তিনি প্রণিপাত করলেন। বিশ্বাবসু নীলমাধবের বেদীতে অর্ঘ্য নিবেদন করলেন। তারপর আবার বিদ্যাপতির চোখ বেঁধে ফিরিয়ে আনলেন ঘরে। ভোর রাত পেরিয়ে সকাল হল। সবাই নিদ্রা ছেড়ে উঠে পড়ল। প্রভাতী শবরসভায় সবাইকে একে একে দেখা গেল, শুধু বিদ্যাপতিকে দেখা গেল না। শুরু হল তাঁর খোঁজ। না, ঘরে-দ্বারে-শয্যায় কোথাও তাঁকে খুঁজে পাওয়া গেল না। সারাটা দিন সমস্ত শবররাজ্যে খোঁজাখুঁজি হল, কিন্তু, কোত্থাও পাওয়া গেল না। কোথায় গেল লোকটা! ললিতা যেন হতবাক হয়ে গেল। বিশ্বাবসুর মনে কিন্তু অন্য সন্দেহ হল! নীলমাধব সুরক্ষিত আছেন তো! গুপ্ত মন্দিরে গিয়ে দেখতেও পারছেন না, থাকতেও পারছেন না! অস্থির হয়ে রাগে দাঁত ঘষতে লাগলেন সারাটা দিন। হা রে বিদ্যাপতি, এই জন্য তোর এত ছলনা! রাত্রে নিরসন হল সেই সন্দেহের। না, নীলমাধব তো ঠিকই আছেন! তাহলে, এমন বেপাত্তা হয়ে গেল কেন লোকটা!
শবররাজ্যে যখন বিদ্যাপতিকে খুঁজে না পেয়ে হুলুস্থুল অবস্থা, তখন তাঁকে দেখা গেল উৎকলরাজ ইন্দ্রদ্যুম্নের সভায়। নীলমাধবের খোঁজ মিলেছে! এতদিনে! বিদ্যাপতির জয়ধ্বনিতে ভরে উঠল সভা। এবার তো প্রাণের নীলমাধবকে বরণ করে আনতে হবে। কিন্তু, এনে তাঁকে তো সাধারণ মন্দিরে রাখা যাবে না! রাজা বহুমূল্য রত্নখচিত সুদৃশ্য মন্দির নির্মাণের আদেশ দিলেন। রাজার আদেশে ঘড়িতে ঘোড়া ছোটে। ফলে, শুরু হল মন্দির নির্মাণের কাজ। রাতদিন এক করে কয়েক সহস্র কারুশিল্পীর শ্রমে অল্পদিনেই শেষ হল মন্দিরের নির্মাণ। শিল্পসুষমায় ঐশ্বর্যে সে হল অপূর্ব! তখন রাজার অন্দরবাইরে সেনামহলে সাজ সাজ রব উঠল। রাজা নিজে সৈন্য নিয়ে কুচ করে এগোতে লাগলেন শবর রাজ্যের দিকে। নীলমাধব উদ্ধারে শবরেরা বাধা দিলে, ক্ষমতার অঙ্কুশে যাতে তাদের সহজেই প্রতিহত করা যায়--তাই এত আড়ম্বর, এত আয়োজন! তাই এত ঘটা! তাই এত সৈন্যের সমারোহ! স্বয়ং রাজা চলেছেন সঙ্গে! আর তাঁদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন বিদ্যাপতি। নীলগিরি পর্বতের পাদদেশে আসতেই বিদ্যাপতি লক্ষ করলেন, তাঁর ফেলা সর্ষের দানা থেকে এ-ক'দিনেই বেরিয়ে এসেছে অঙ্কুর! গুহামন্দিরে তাদের নিয়ে যাবে অঙ্কুররেখা। তা-ই অনুসরণ করে বিদ্যাপতির সঙ্গে বীরদর্পে এগোতে লাগল উৎকল সৈন্যদল। এই সময় শবর সীমারক্ষীদের চোখ পড়ল তাদের ওপর। অমনি তারা ছুটতে ছুটতে খবর দিল বিশ্বাবসুকে--একজন রাজা বিপুল সৈন্য নিয়ে এগিয়ে চলেছেন নীলগিরি পর্বতের দিকে, আর তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পলাতক বিদ্যাপতি! ব্যস, বিশ্বাবসুর বুঝতে বাকি রইল না আর কিছু। কেন যে কালসাপকে ঘরে আশ্রয় দিয়েছিলেন! তাহলে এই ছিল বিদ্যাপতির মনে! কিন্তু, প্রাণ থাকতে তিনি কিছুতেই বিদ্যাপতির দুরভিসন্ধি পূর্ণ হতে দেবেন না। শবরসৈন্যদের নিয়ে তিনি ঘুর পথে উঠে এলেন পর্বতে। আজ মুখোমুখি লড়াই হবে মরণপণ, প্রাণপণে রক্ষা করবেন নীলমাধবের গুহামন্দির!
মুখোমুখি হল দুইপক্ষ। বিদ্যাপতিকে বিপক্ষের সম্মুখভাগে দেখে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন বিশ্বাবসু। তারপর রাজায়-রাজায় দেবতার অধিকার নিয়ে শুরু হল উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, আস্ফালন; অনিবার্য হয়ে উঠল যুদ্ধ। এবার নড়ে চড়ে বসলেন ভগবান। দুই ভক্তকে তো লড়তে দেওয়া যায় না, কারও রক্তপাত তো তাঁর কাছে কাম্য নয়! তাই দুই যুদ্ধোদ্যোত ভক্তকে থামিয়ে দিতে দৈববাণী হল। ভূমণ্ডল গমগমিয়ে উঠল দেবকণ্ঠে। নীলমাধব বললেন, 'হে বিশ্বাবসু, তুমি দুঃখ পেও না, তোমার আবাস ছেড়ে যাবার কাল এসেছে, নবরূপে জগতে আমার আবির্ভাবের সময় হয়েছে। তুমি আমার বর্তমান স্বরূপ রাজাকে সমর্পণ কর। আমি তোমার আবাস ছেড়ে যাচ্ছি বটে, তোমাদের ছেড়ে যাচ্ছি না। বিদ্যাপতিকে তুমি ক্ষমা করো, সে আসলে আমারই আজ্ঞাবাহক। আমারই লীলার অংশ। তোমার কন্যা ললিতা ও বিদ্যাপতির সন্তানেরা আমার সেবা করবে চিরকাল, এটাই নিয়তি।' তারপর নীলমাধব রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে আদেশ দিলেন তাঁকে নিয়ে গিয়ে নবরূপে দারুমূর্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করে পুজো করতে। তিনি উৎকলরাজ্যে প্রবেশ করলেই সমুদ্রজলে ভেসে আসবে নব কলেবর নির্মাণের কাঠ। দৈববানী স্তব্ধ হল। দুই যুযুধান সংযত হলেন। দেবতার আদেশ ভক্তেরা মানবেন না, এও কি সম্ভব! তাই, বিশ্বাবসু ক্ষমা করলেন বিদ্যাপতিকে। তারপর চোখের জলে প্রাণের ঠাকুর তুলে দিলেন রাজার হাতে। তখন মহাসমারোহে রাজা ফিরলেন রাজ্যে। বিদ্যাপতিও ফিরলেন। তাঁর সঙ্গী হল, ললিতা।
ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজ্যে ফিরতেই নীলমাধবের ইচ্ছায় সমুদ্রে ভেসে এলো বিশাল এক কাষ্ঠ খণ্ড। রাজা সেই কাষ্ঠ খণ্ড তুলে আনালেন রাজপুরীতে। কিন্তু, তা দিয়ে বিষ্ণুর নবরূপ খোদাই করতে পারেন, সারা রাজ্যে এমন দারুশিল্পী কাউকে পেলেন না তিনি। হতাশ হয়ে রাজা যখন বিমর্ষ হলেন, শরণ নিলেন আরাধ্য বিষ্ণুর; তখন বিষ্ণুর আদেশে স্বয়ং বিশ্বকর্মা স্বর্গ থেকে নেমে এলেন। সাধারণ এক দারুশিল্পীর বেশে রাজার কাছে এসে তাঁকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন, ভগবান বিষ্ণুর এমন অপূর্ব রূপ তিনি ফুটিয়ে তুলবেন, যা ত্রিজগতের কেউ কখনো দেখেননি। তবে তাঁর একটাই শর্ত, তিনি মূর্তি নির্মাণ করবেন বদ্ধ কক্ষে। নির্মাণকার্য শেষ হওয়ার আগে সেই কক্ষের দরজা যদি কেউ কোনভাবে খুলে ফেলেন, তাহলে তিনি তৎক্ষণাৎ নির্মাণকার্য ছেড়ে চলে যাবেন। বেশ, এ শর্ত মানতে রাজার আর অসুবিধে কী! তিনি মূর্তি নির্মাণের কক্ষ নির্দিষ্ট করে দিলেন। বিশ্বকর্মা তাতে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করলেন। শোনা যেতে লাগল ধাতু-কাঠের অবিরাম ঠুক ঠাক শব্দ।
কয়েকদিন এভাবেই কেটে গেল। তারপর হঠাৎ একদা ধাতু-কাঠের ঠোকাঠুকির সেই শব্দ থেমে গেল। একদিন গেল, দু'দিন গেল। রাজা ভাবলেন, এ কী রকম হল! রানি ভাবলেন, ব্যাপারটা কী! মূর্তি নির্মাণ কি তাহলে সম্পুর্ণ? না...তেমন হলে তো দারুশিল্পী স্বয়ং এসে সংবাদ দিত! তাহলে কি সে অসুস্থ হয়ে পড়ল? নাকি, বদ্ধ ঘরে প্রাণত্যাগ করল! এমন ভাবনা হতেই মন প্রবল উচাটন হয়ে উঠল। কিছুতেই আর মানতে চাইল না। দারুণ অস্থির হয়ে একটানে খুলে ফেললেন দরজা। আর তখনই ঘটে গেল অঘটন! চোখের সামনে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই দারুশিল্পী! কক্ষে রয়ে গেল শুধু তিনটি মূর্তি। হাত নেই, পা নেই--আবক্ষ ঈশ্বর! দুটি পুরুষ মূর্তি, একটি নারীর। তবে, দারুশিল্পী মূর্তি অসম্পূর্ণ রেখে গেলেও রচনা করে গেছেন তাঁদের অপূর্ব মোহময় চোখ, সে চোখের দিকে তাকিয়ে আশ যেন কিছুতেই মিটছে না! মনে হচ্ছে, ব্রহ্মাণ্ডের অপার রূপ আর রহস্যময়তা যেন ধরা পড়েছে তাতে, অপলক চেয়েও সে রহস্যের ঘোর কই কিছুতেই তো কাটছে না! তখন রাজারানি বুঝলেন, আসলে এই অনন্য রূপমাধুরীতে এই কলেবরেই ভগবান জ্যোতি থেকে মূর্তিমান হতে চেয়েছিলেন, হয়েওছেন তাই। এও আসলে সেই লীলাময়েরই আরেক লীলা!
তারপর? তারপর আর কী, এক শুভ দিনে শুভক্ষণে মহাসমারোহে মন্দিরের রত্নবেদীতে সেই তিন মূর্তি--'সুভদ্রা', 'বলরাম' আর প্রিয় সুদর্শনকে সঙ্গে নিয়ে 'জগন্নাথ' নাম ধারণ করে দারুব্রহ্ম নারায়ণ অধিষ্ঠিত হলেন। শুরু হল, জগন্নাথদেবের জয়যাত্রা। তবে, যেটা লক্ষণীয় তা হল, দেবতা এখানে নীলমাধবের মতো একা নন, তাঁর বামে হ্লাদিনীও নেই; আছেন কেবল ভাই আর বোন। জগতের নাথ এইভাবে যেন পারিবারিক সৌভ্রাতৃত্বের উদাহরণ রেখে জগৎসংসারকে শিক্ষা দিতে চাইলেন। পুত্রকন্যাপতিসহ মা দুর্গার আবাহনকাল ছাড়া পরিবার-প্রীতির মধ্য দিয়ে আর কোন দেবতার পুজোয় এমন বিশ্বপ্রেমের বার্তা পাওয়া দুর্লভ।
কালের উপাখ্যানে নীলমাধব বা জগন্নাথ যেমন নিছক শবরদের দেবতা হয়ে থাকেননি, তেমনি শুধুই হিন্দুদের দেবতা হয়েও থাকেননি। যিনি জগতের নাথ; তিনি কি ব্যক্তি-সম্প্রদায়-ধর্মবিশেষের দেবতা হয়ে থাকতে পারেন! তাই বৌদ্ধ অভ্যুত্থানের সময় তিনি বৌদ্ধদের কাছে হয়ে উঠলেন 'আদি বুদ্ধ', জৈনদের কাছে আদি তীর্থঙ্কর 'ঋষভদেব', শাক্তদের কাছে 'দক্ষিণাকালী', ব্রহ্মবাদীদের কাছে 'দারুব্রহ্ম', বৈষ্ণবদের কাছে 'গোলকবিহারী', তন্ত্রসাধকের কাছে 'ভৈরব'—এভাবেই বিভিন্ন সময়ে নানান নামে নানান উপাচারে পূজিত হয়েছেন তিনি। এখনও হন। তাই তাঁর পূজামন্ত্রে আছে সমস্ত ধর্মের অনুষঙ্গ, পূজায় নানান ধর্মের আচার। এমনকি সাম্প্রদায়িক অনুশাসনে যে-সব ধর্ম বা শ্রেণির মানুষ মন্দিরে প্রবেশের অধিকার পান না, রথযাত্রার সময় তিনি পথে নেমে তাদের দর্শন আর স্পর্শ দিয়ে ধন্য করেন, নিজেও ধন্য হন। বুঝিয়ে দিতে চান ঈশ্বরের পথে সবাই সমান, তাঁর কাছে আসার কোন অনুশাসন নেই, থাকতে পারে না। সমস্তটাই মানুষের বানানো। আর এখানেই লুকিয়ে আছে জগন্নাথদেবের পবিত্র রথযাত্রার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য।