সময় বদলেছে। তবু যেন কোথাও কোথাও থমকে থাকে ইতিহাস। তাকে ধরা যায়, ছোঁয়া যায়, স্পর্শ করা যায়। জীবন্ত ইতিহাস আয়নায় মুখ দেখার মতো স্পষ্ট। তেমনই এক ইতিহাসের কাহিনী থমকে আছে হুগলির খন্যানে। ইটাচুনা রাজবাড়ীর অলিন্দে।
ইটাচুনা রাজবাড়ীর অন্য নাম বর্গী ডাঙ্গা। বর্গী থেকে এই নাম টি এসেছে। মারাঠা রা বাংলা আক্রমণ করেছিল। টানা দশ বছর বাংলায় ছিল লুটপাট আর অন্ধকারের নবাব আলীবর্দী খাঁ তা কিছুটা সামলাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মারাঠা আক্রমনকে প্রতিহত করা সহজ কাজ ছিল না। দুর্ধর্ষ মারাঠা বাংলা আক্রমণ করে। ১৭৪২-কি ১৭৫২ পর্যন্ত ভাস্কর পন্ডিত আর রঘুরাজ ভোঁশলের নেতৃত্বে এই লুটত রাজ্ চলে। মারাঠা লুঠেরাদের নাম দেওয়া হয় ‘বর্গি’। মেদিনীপুরের কাছে তারা বাস শুরু করে। তারা বাংলা-বিহার-ওড়িশার জমিদারদের কাছ থেকে ‘চৌথ’ কর আদায় করত। ঔরঙ্গজেবের শাসনের শেষ ভাগ থেকে বাংলায় বর্গী হানা শুরু হয়েছিল। অনেক কাল ধরে এই লুটতরাজ চলার পরে, মির হাবিবের মৃত্যুর পর মারাঠা লুটেরা এই দস্যুবৃত্তি থেকে সরে আসে। বাংলার নবাবের সঙ্গে তাদের শান্তি চুক্তি স্থাপিত হয়। তারা বাংলা ছাড়ে। বহু মারাঠা বর্গীরা বাংলায় বাস শুরু করে। লুটপাটের ফলে তারা বেশ ধনী হয়েছিল। এখানেই নতুন করে ব্যবসা শুরু করে। ' কুন্দ্রা ' রা ছিল তেমনই মারাঠা বর্গী। বঙ্গে মিশে তারা হয় ' কুন্ডু। বাংলার জল হাওয়ায় মিশে তারা বাঙালি সংস্কৃতিকেই আপন করে নেয়।
১৭৬৬ সালে বর্ধমানের পাণ্ডুয়াতে সাফল্য নারায়ণ কুন্ডু ইটাচুনা রাজবাড়ীর প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতে জমিদারি প্রথার অবসান ঘটলে বর্গীডাঙ্গাতেও তার প্রভাব পড়ে।
বর্তমানে ইটাকানা রাজবাড়ীর দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে অতিথিদের জন্য।
তিন মহলের রাজবাড়ী। ইউরোপীয়ান স্থাপত্যের অনুকরণে তৈরি। বিরাট বিরাট দালান।
রাজকীয় বাতি স্তম্ভ। ঝরোখা। অলিন্দ। ঝাড়বাতি, ঠাকুর দালান, পঙ্খের কাজ সব কিছু থেকে ঠিকরে আসে আভিজাত্য। সাবেকি অন্দরমহল আসলে যেন ভুলভুলাইয়া। পা রাখলেই জেগে ওঠে ঝলমলে অতীত। বার মহলেও হারানো অতীতের গন্ধ। পুরনো সিন্দুক, আসবাব, পালঙ্ক, বাতিদান, দেওয়াল ঘড়ি, সিংহ দুয়ার মায়াময় নস্ট্যালজিয়ার ফিরিয়ে নিয়ে যায় বারবার। যেন হাত বাড়ালেই মুহূর্তে ছুঁয়ে ফেলা যায় অতীতকে।
ইটাচুনা রাজ্ বাড়িতেই আছে একটি শিব মন্দির। ১৮৭১ সালে বিজয় নারায়ন কুন্ডু ম একটি শিব মূর্তি পান গিরিডির জঙ্গল থেকে। চিরাচরিত শিব লিঙ্গ নয়. সাদা রঙের শিব মূর্তি। মঙ্গল কাব্যে যেভাবে বুড়ো শিবের বর্ণনা করা হয়েছে ঠিক সেরকমই অনেকটা মূর্তির রূপ. সাদা রঙের শিবকে দেখলে মনে হবে গ্রাম বাংলার মাটির দাওয়ায় বসে থাকা কোনও দায়িত্ববান গৃহ স্বামী। বিজয় নারায়ণ কুন্ডু সেই মূর্তি নিয়ে আসেন বাড়িতে। মন্দির তৈরী করে ভোলা মহেশ্বরকে প্রতিষ্ঠাও করা হয়. কিন্তু শোনা যায় তার পর থেকেই রাজ্ প্রাসাদে নানা অলৌকিক কান্ড কারখানা ঘটতে থাকে। মৃত্যু হয় পরিবারের এক সদস্যের। তারপর থেকে শিব মন্দিরটিতে বন্ধ করে দেওয়া হয় পুজো। ইটাচুনা রাজ্ বাড়িতে শ্রীধর জিউয়ের মন্দির আছে।
দোলপূর্ণিমা ও জন্মাষ্টমীর দিন পুজো হয় শ্রীধরকে ঘিরে। দোলের আগের দিন পালকিতে করে শ্রীধরকে ঘোরানো হয় গোটা গ্রাম।
ইটাকাচুনা রাজবাড়ির সংগ্রহশালা ঘুরে দেখার সুযোগ আছে. সাধারণ ভ্রমণার্থীরাও সে সুযোগ পান। রাজবাড়ীর নানা ঐতিহাসিক সামগ্রী রাখা আছে এখানে।