চাঁদের মাটিতে পা রাখার পরেই ইসরোর লক্ষ্য ছিল সূর্য। শনিবার বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে ইসরোর সৌরযান ‘আদিত্য এল-১’ সূর্যের পথে রওনা দিয়েছে। ভারতীয় রকেট ‘পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল’ (পিএসএলভি)-এ চেপে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধওয়ান স্পেস রিসার্চ সেন্টারের লঞ্চিং প্যাড থেকে আদিত্য এল-১-এর উৎক্ষেপণ হয়েছে।
এটি হচ্ছে ভারতের প্রথম সূর্য অভিযান। এই অভিযান সফল হলে সূর্যকে কাছ থেকে পেয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ এবং সেটা গবেষণা করতে পারবে ইসরো। সূর্যের আর এক নাম আদিত্য, সেই থেকেই এই নাম রাখা হয়েছে এই অভিযানের।
পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার পথ যাবে ইসরোর এই মহাকাশযান। সেই পথ অতিক্রম করতে তার ১২৫ দিন সময় লাগবে। জানা গিয়েছে যে সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে একটি ‘হ্যালো’ কক্ষপথের ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্ট বা এল১ পয়েন্টে স্থাপন করা হবে মহাকাশযানবাহী কৃত্রিম উপগ্রহটিকে। সেখান থেকে সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করবে আদিত্য-এল১।
জানা গিয়েছে আদিত্য-এল১-এ মোট সাতটি পেলোড রয়েছে। এই পেলোডগুলিকে কৃত্রিম উপগ্রহটির ‘হাত’ বলাও যেতে পারে। ইসরোর সূর্য অভিযানের প্রত্যেকটি কাজ এই পেলোডগুলির উপরেই নির্ভর করছে।
ইসরোর খবর অনুযায়ী, এই পেলোডগুলিকে দু’টি অংশে ভাগ করা হয়েছে। সেখানে রয়েছে চারটি রিমোট সেন্সিং পেলোড এবং তিনটি ইন-সিটু পেলোড।
সৌরযানের রিমোট সেন্সিং পেলোডগুলি হল —
- সোলেক্স (সোলার লো এনার্জি এক্স-রে স্পেক্টোমিটার),
- এসইউআইটি (সোলার আলট্রাভায়োলেট ইমেজিং টেলিস্কোপ),
- ভিইএলসি (ভিসিবল এমিশন লাইন কোরোনাগ্রাফ), এবং
- এইচইএল১ ও এস (হাই এনার্জি এল১ অরবিটিং এক্স-রে স্পেক্টোমিটার)
অন্যদিকে, সৌরযানের ইন-সিটু পেলোডগুলি হল —
- অ্যাসপেক্স (আদিত্য সোলার উইন্ড পার্টিকেল এক্সপেরিমেন্ট),
- পাপা (প্লাজমা অ্যানালাইজার প্যাকেজ ফর আদিত্য) এবং
- এটিএইচআরডিএম (অ্যাডভান্সড ট্রাই-অ্যাক্সিয়াল হাই রেজোলিউশন ডিজিটাল ম্যাগনেটোমিটার)
সূর্যের একেবারে বাইরের দিকের অংশটির নাম হল কোরোনা। এই অংশেই ভিইএলসি পেলোড কাজ করবে।এই পেলোডটি কোরোনা স্তরের ছবি তুলবে এবং ওই অংশের স্পেকট্রোস্কোপিও করবে ভিইএলসি পেলোড । সূর্যের কোরোনা স্তর থেকে কী ভাবে আলোর রশ্মি বিক্ষিপ্ত হচ্ছে, কেমন ওই স্তরের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন, এই সবকিছুই খতিয়ে দেখবে ভিইএলসি।
আদিত্য-এল১-এর সোলেক্স পেলোডটির কাজ হচ্ছে সূর্যের গুণাগুণ বিচার করা এবং সেই তথ্য সংগ্রহ করা। এই পেলোডটি কাজ করবে সফ্ট এক্স-রে স্পেকট্রোমিটারের হিসেবে।
এইচইএল১ওএস পেলোডটির কাজও একই রকমের। এই পেলোডটি খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করবে সূর্য কেমন। তবে এটি সফ্ট নয়, হার্ড এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার হিসাবে কাজ করবে।
রিমোট সেন্সিং পেলোডগুলি মধ্যে চতুর্থ পেলোডটি হল এসইউআইটি পেলোডটি সূর্যের অন্য দুই স্তর নিয়ে কাজ করবে। তার দুই স্তর হল ফটোস্ফিয়ার এবং ক্রোমোস্ফিয়ার। সূর্যের পৃষ্ঠতলের নাম ফটোস্ফিয়ার। আমরা এই অংশটিই পৃথিবী থেকে দেখতে পাই। কোরোনা স্তরের মাঝে রয়েছে প্লাজমার একটি পাতলা স্তর তাকেই বলা হয় ক্রোমোস্ফিয়ার। এই দুই স্তর পর্যবেক্ষণ করে সেখানকার ছবি তুলে পাঠাবে ইসরোর পেলোড। এ ছাড়া,
আদিত্য-এল১-এর ইন-সিটু পেলোড অ্যাসপেক্স সূর্যের ভিতরের বায়ু এবং বিভিন্ন কণাকে পরিক্ষা করবে। মূলত এই পেলোডের উপর দায়িত্ব রয়েছে প্রোটন এবং তার ভারী আয়নগুলি কোন দিকে নির্দেশ করে সেটা পর্যবেক্ষন করা।
পাপা পেলোডটির কাজও হচ্ছে সূর্যে অবস্থিত কণা নিয়ে। এটি সূর্যের ইলেকট্রন এবং তার ভারী আয়নগুলি পরিক্ষা করবে এবং সেগুলি কোন দিকে নির্দেশ করছে, সেটাও খতিয়ে দেখবে এই পেলোডটি।
আদিত্য-এল১-এর সপ্তম ও শেষ পেলোডটি হচ্ছে এটিএইচআরডিএম। এই পেলোডটির কাজ হল সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রকে নিয়ে এবং সেটির ওপর পরিক্ষা- নিরিক্ষা করার দায়িত্ব এটিএইচআরডিএমকে দিয়েছে ইসরো।
ইসরোর খবর থীকে জানা গিয়েছে যে সৌরযানের উৎক্ষেপণের পর প্রায় ১৬ দিন পৃথিবীর চারিদিকে পাক খাবে আদিত্য-এল১ এবং সেই সময়ের মধ্যেই পাঁচটি ধাপে কক্ষপথ ঘুরে গতিবেগ বৃদ্ধি করবে। আদিত্য এল-১-এর ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্টে পৌঁছতে আরও ১০৯ দিন সময় লাগবে। এই অঞ্চলে পৌঁছে কৃত্রিম উপগ্রহ স্থির থাকতে পারবে কারন সূর্য এবং পৃথিবীর মতো দুই বস্তুর পারস্পরিক আকর্ষণ এবং বিকর্ষণের ফলে একটি স্থিতিশীল অঞ্চল গড়ে ওঠে সেখানে। এই ল্যাগ্রেঞ্জ পয়েন্টকে মহাকাশযানের ‘পার্কিং স্পট’ও বলা হয় কারণ সেখানে কম জ্বালানি খরচ করে এবংমহাজাগতিক কাজের উপর নিশ্চিন্তায় নজরদরি চালাবে। ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্টে তার ‘হাত’ হয়ে কাজ করবে ওই সাতটি পেলোড।
এই সৌরযান যদি সফল হয় তবে ভারত সহ পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের কাছে সূর্যের ওপর অনেক নতুন তথ্য তাদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে। এই নিয়ে আশাবাদী রয়েছে গোটা ইসরো মহল।