ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এদেশ নানা কাজের জন্য তাঁকে মনে রেখেছে। তিনি আজও শাশ্বত। তাঁর অগণিত জনদরদী কাজের মধ্যে অন্যতম এক কাজ হল বিধবা বিবাহ প্রবর্তন। সমাজপতিদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের প্রচলন করেছিলেন।
কিন্তু তার বদলে জুটে ছিল তীব্র সমালোচনা। তদানিন্তন কলকাতায় সং বেরত তাঁর নামে। লোকেরা ব্যঙ্গবিদ্রুপে বিদ্ধ করত তাঁকে। কিন্তু তিনি ছিলেন অনড়। লক্ষ্যে অবিচল মানুষ। একটি সমালোচনারও পাল্টা উত্তর করতেন না, এটিই তাঁর চরিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।
বিদ্যাসাগরের সমালোচকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। ১৮৭১ সালে ‘ক্যালকাটা রিভিউ’-তে বেঙ্গলি লিটারেচার শীর্ষক প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরের রচনার প্রথম সমালোচনা করেন বঙ্কিম।
এরপর ১৮৭২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর নিজের সম্পাদিত পত্রিকা বঙ্গদর্শনে, ১২৭৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রথম বর্ষের ২য় সংখ্যায় ‘উত্তরচরিত’ নামক প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরকে কটাক্ষ করলেন বঙ্কিম, তিনি লিখলেন, ‘তাঁকে "কাব্য রসজ্ঞ" বলিয়া স্বীকার করি না।’ এটিই ছিল বাংলা ভাষায় বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম সাহিত্য-সমালোচনা।
বঙ্কিমচন্দ্র ভবভূতির উত্তরচরিত গ্রন্থের সমালোচনা করেন ঐ প্রবন্ধে, সেখানেই অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বিদ্যাসাগরকে টেনে এনে আক্রমণ করেন। ঐ বছরই বঙ্কিমচন্দ্র লিখলেন বিষবৃক্ষ। ধারাবাহিকভাবে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত হল সেই উপন্যাস।
এই উপন্যাসের নায়িকা সূর্যমুখীর মুখ দিয়ে ঔপন্যাসিক বঙ্কিম বলালেন, ‘ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে নাকি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবা বিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মূর্খ কে?’
এইভাবেই নিজের কলমকে ব্যবহার করে বিদ্যাসাগরকে আক্রমণ করলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। শুধু তাই নয়, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন থেকে শুরু করে বহুবিবাহ বা বাল্যবিবাহ রোধ, বিদ্যাসাগরের প্রতিটি সামাজিক সংস্কারমূলক কাজের বিরোধিতা করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র।
এরপর একবার বিদ্যাসাগর সম্পর্কে, কুমার বিনয়কৃষ্ণ দেবকে লেখা একটি চিঠিতে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘শাস্ত্রের দোহাই দিয়া কোনো প্রকার সমাজ সংস্কার যে সম্পন্ন হইতে পারে, অথবা সম্পন্ন করা উচিত, আমি এমন বিশ্বাস করি না। যখন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় বহুবিবাহ নিবারণের জন্য শাস্ত্রের সাহায্য গ্রহণ করিয়া আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছিলেন, তখনও আমি এই আপত্তি করিয়াছিলাম এবং সে মত পরিবর্তন করার কোন কারণ দেখি নাই।বাঙালি সমাজ শাস্ত্রের বশীভূত নহে দেশাচার বা লোকাচার বশীভূত।’
এই বিরোধীতা তিনি এতটাই নিম্নস্তরে নামিয়ে এনেছিলেন যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিদ্যাসাগারের অবদানকেও মান্যতা দিতেন না তিনি। এমনকি কবি সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্তের চেয়েও বিদ্যাসাগর রচিত সাহিত্যকে প্রকাশ্যে নিম্নমানের বলে দাবি করতেন বঙ্কিমচন্দ্র। এই ঈশ্বর গুপ্তও বিদ্যাসাগরকে আক্রমণ করতে ছাড়েননি। সে সময় সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা সম্পাদনা করতেন ইশ্বর গুপ্ত। তীব্র ব্যক্তি আক্রমণ শানিয়ে সংবাদ প্রভাকরে কবি ইশ্বর গুপ্ত লিখলেন -
আমি শুনে এলেম ওদের টোলে, শুনে মন
গেল উতুলে, রাঁড়ের বিয়ের ছাপা নাকি এসেছে।
বুঝি বিদ্যাসাগর এতদিনে, বিধবা নারীগণে,
একলা শোওয়ার কত জ্বালা জেনেছে।
সমাজের উন্নতিসাধন করতে গিয়ে, বিদ্যাসাগরের জুটেছে কেবল নানা ধরনের কুৎসা। কিন্তু এসবে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি তিনি। ব্যক্তিগত আক্রমণের জবাবে কখনও পাল্টা আক্রমণ করেননি বিদ্যাসাগর।
একদা বর্ধমানে, তারকনাথ বিশ্বাসের বাড়িতে ভোজসভার আয়োজন করলেন বিদ্যাসাগর, ঠিক করলেন নিজের হাতেই সকলকে রেঁধে খাওয়াবেন। করলেনও তাই, সেদিনের মেনুতে ছিল পাঁঠার ঝোল আর আম আদা পাঁঠার মেটের অম্ল। নিমন্ত্রিতদের তালিকায় ছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। খেতে খেতে প্রীত হয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বলে উঠলেন, 'এমন সুস্বাদু অম্ল তো কখনও খাই নাই।' সেই ভোজসভায় নিমন্ত্রিতদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাই সঞ্জীবচন্দ্রও ছিলেন। তিনি বললেন, 'হবে না কেন, রান্নাটা কার জানো তো, বিদ্যাসাগরের।'
বিদ্যাসাগরও হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, বঙ্কিমকে খানিক ঠুকেই, 'না হে না! বঙ্কিমের সূর্যমুখী আমার মতো মুর্খ দেখেনি।' বঙ্কিমচন্দ্র আর কিছুই বলতে পারেননি।
অন্য এক ঘটনা: জনৈক এক ভদ্রলোক বঙ্কিমচন্দ্রের নিন্দা করছেন বিদ্যাসাগরের কাছে। বঙ্কিমের চরিত্র নিয়ে ইঙ্গিত করে বলছেন কদর্যভাবে রাত কাটান বঙ্কিম। সব শুনে বিদ্যাসাগর বলে উঠলেন 'বলো কী? সারাদিন এত বড় সরকারি দায়িত্ব পালন করেও এভাবে রাত কাটায়, তাহলে লেখে কখন! আমার তো একটা সেলফ তাঁর বইয়ের ভরে গেল। যাই বল তোমার কথা শুনে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা আমার বেড়ে গেল।'
এমনই ছিলেন বিদ্যাসাগর। আক্রমণের সব শর নিজের বুকে ধারণ করতেন। বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখাতেন না। সারা জীবন কাঁটার মুকুটের মতো পরেছেন সব আঘাত। হয়ে উঠেছেন সাক্ষাৎ নীলকন্ঠ।