সকালবেলায় সারি দিয়ে ছাত্রছাত্রীর দল এগিয়ে চলেছে, সামনে চলেছেন শিক্ষক শিক্ষিকারা। হাতে বড় বড় প্ল্যাকার্ড। বাদ্যযন্ত্রে দিম-দিম ধ্বনি তুলে এগিয়ে চলেছে প্রভাতফেরী।
-এ সময়ে এ ছবি সচরাচর দেখা যায় না অথবা বিরল বলাই ভালো। আজ ২৬ সেপ্টেম্বর, সকালবেলা এহেন ছবি দেখে ক্ষণিক থমকে গিয়েছিল শহরের গতিবিধি। আর এই দৃশ্যের নেপথ্যে যিনি, তিনি বাংলার শিক্ষার অগ্রগামী, অপসংস্কৃতির সংস্কারক- ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় ওরফে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। একবিংশ শতকে তাঁর ১৯৯তম জন্মবার্ষিকীর পূর্তিতে সারা বাংলা জুড়ে স্মৃতির আলোয় তাঁর এই প্রদীপ্ত হয়ে ওঠা যেন সময়েরই মঙ্গলগান।
“কাকের বাসায় কোকিলে ডিম পাড়িয়া যায়-মানব ইতিহাসের বিধাতা সেইরূপ গোপনে কৌশলে বঙ্গভূমির প্রতি বিদ্যাসাগরকে মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন।“ বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের এ উক্তি যথার্থই বলা চলে। ঊনিবিংশ শতাব্দীর বাঙালি সমাজের নৈতিক ও চারিচত্রিক অবক্ষয়ের যে সুবিস্তীর্ণ ইতিহাস, এ প্রজন্ম যদি সে ইতিহাস সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতে চায়, তাইই বলে দেবে বাংলার সমাজ-শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের উদ্ভব ঘটেছিল,তার প্রভাবে ধর্ম, সাহিত্য, শিক্ষা, শিল্প প্রভৃতি নানা দিকে সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার উদ্যম চলতে থাকে। নবজাগরণের ভাবগত মৌল বৈশিষ্ট্য ছিল মানবিকতার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা। যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে সব কিছু যাচাই করে নিয়ে সবরকম কুসংস্কার, অবিচার, অত্যাচার ও অসত্যের বন্ধন থেকে মানুষকে মুক্ত করে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে হবে-ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ ও মানবিকতার অধিকারকে স্বীকার করতে হবে-এই হচ্ছে নবজাগরণের বাণী।
বিদ্যাসাগর ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন বড় হিউম্যানিস্ট। তিনি নবজাগরণের সমস্ত চিন্তাদর্শকে নানা জনহিতকর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে সমাজে সকল মানুষের মধ্যে প্রসারিত করতে পেরেছিলেন। প্রকৃত মানুষের ধর্ম বলতে যা বোঝায় বিদ্যাসাগর ছিলেন সেই আদর্শেরই প্রতিভূ। একটা জাতির আত্মপ্রকাশ ও আত্মসাধনার জন্য প্রাথমিক প্রয়োজন সুনিয়ন্ত্রিত ও সুগঠিত ভাষাসম্পদ। নিজে দারিদ্রের মধ্যে থেকে অন্যের দারিদ্র দূরীকরণের সদিচ্ছা সকলের মধ্যে থাকেনা। আজ আর তা নেইও। শিক্ষা, সাধনা, ব্যক্তিগতজীবন চর্চা, সাহিত্য সাধনা, দানশীলতা ও কর্মজীবন –সবকিছুর মধ্যেই বিদ্যাসাগরের অকৃত্রিম মনুষ্যত্ব ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ পেয়েছে।
সৃষ্টিশীলতা দিয়েই মানবিকতাকে অনুধাবন করতে হবে। সৃষ্টি ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যের দিক থেকে-আবার সৃষ্টি সমাজের সমষ্টিগত মানুষের দিক থেকেও বটে। যদি ব্যক্তি কিংবা কতিপয় ব্যক্তিবিশেষের চিন্তাদর্শ দেশের নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে জীবনের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ না পায়-তবে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতই স্বল্পকালের মধ্যে তাঁর প্রভাবক্রিয়া বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই থাকে বেশি।
আজ বর্ণের পরিচয় গিয়েছে বদলে। ভাষা, রুচি, জ্ঞান, শিক্ষা, বোধ সবেরই বিবর্তন ঘটেছে। বাংলা ‘ডিসলভ’ হওয়ার প্রস্তুতিতে। এ অবস্থায় একমাত্র ‘সার্চ’ বা ‘অন্বেষণ’ না থাকলে কোথাও পৌঁছানো অসম্ভব। তাই- ঈশ্বরচন্দ্র ‘কে’, ‘কেন’, ‘কিভাবে’, ‘কি করে’ –এ সম্বন্ধে সময় অথবা প্রজন্মের মধ্যে বিন্দুমাত্র কৌতুহলের উদ্রেগ হলে সেই ‘সার্চ’ বা ‘অন্বেষণ’ই পারবে তাঁর ভাবাদর্শ পুনরুজ্জীবিত করতে, তার কারণ এ সময়ের প্রয়োজন ‘রেনেসাঁ’ ও একজন ‘বিদ্যাসাগর’।