"সেই দরিদ্র ব্রাহ্মণের সন্তান, যাঁহার পিতার দশ বার টাকার অধিক আয় ছিল না, যিনি বাল্যকালে অধিকাংশ সময় অৰ্দ্ধাশনে থাকিতেন, তিনি এক সময় নিজ তেজে সমগ্র বঙ্গসমাজকে কিরূপ কাঁপাইয়া গিয়াছেন তাহা স্মরণ করিলে মন বিস্মিত ও স্তব্ধ হয়। তিনি এক সময়ে আমাকে বলিয়াছিলেন - “ভারতবর্ষে এমন রাজা নাই যাহার নাকে এই চটিজুতাশুদ্ধ পায়ে টক্ করিয়া লাথি না মারিতে পারি।” আমি তখন অনুভব করিয়াছিলাম, এবং এখনও অনুভব করিতেছি যে তিনি যাহা বলিয়াছিলেন তাহা সত্য। তাঁহার চরিত্রের তেজ এমনি ছিল যে, তাঁহার নিকট ক্ষমতাশালী রাজারাও নগণ্য ব্যক্তির মধ্যে।" শিবনাথ শাস্ত্রী "
পাঠক, এই তেজস্বী ব্যক্তিটি কে সেটা নিশ্চয়ই সকলেই বুঝতে পারছেন। এমন মানুষ শুধু পশ্চিমবঙ্গ কেন ভারতেও আর দ্বিতীয় জন্মাননি আজ পর্যন্ত। হ্যাঁ পাঠক বন্ধুরা, আমি ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর - এর কথাই বলছি। তিনি যে কত বড় পন্ডিত ছিলেন, মানুষ হিসেবেও তিনি কত বড় ছিলেন, তাঁর মাতৃভক্তি, নারীশিক্ষা বিস্তারে তাঁর ভূমিকা, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসারে তাঁর ভূমিকা, শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁর অবদান, বিধবা বিবাহের প্রচলন, এই বিষয়গুলিও মোটামুটি আমরা, বাঙালি মাত্রই জানি। আধুনিক সমাজ তৈরির পথিকৃৎ যদি রাজা রামমোহন রায় হয়ে থাকেন, তাহলে দেশকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একই স্থানে আছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
মহাত্মা গান্ধী তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন ...
"Beginning with Rammohan Roy, one heroic fighter after another has raised Bengal to a position higher than that of other provinces. It can be said that Ishwar Chandra Vidyasagar was the greatest among them."
বিদ্যাসাগর সম্পর্কে কিছু বলবো বা লিখবো সেই যোগ্যতা আমার নেই। সে সাহসও আমার নেই, আর তার সম্পর্কে কোন বক্তব্য রাখাটা কেউ আমার মতো একজন ছোটখাটো লেখিকার পক্ষে ধৃষ্টতা বলেই মনে করি। তিনি মানুষের জন্য কী করে গেছেন, এই বঙ্গসমাজকে যে কতোটা এগিয়ে দিয়েছেন সে বিষয়ে কি আর নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন আছে? কিন্তু এইটুকু শুধু আজকে বলতে পারি যে তিনি ছিলেন বলে। শুধুমাত্র তিনি ছিলেন বলেই আজ আমি এবং আমার মত হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ নারীরা পড়তে পারছি, লিখতে পারছি, নিজেদের অন্তরের কথাগুলো লিখে প্রকাশ করতে পারছি। সত্যি কথা বলতে কি তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, একথা নির্দ্বিধায় আমরা বলতে পারি। আজ পর্যন্ত আর একটা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই বঙ্গভূমিতে জন্ম নেননি এবং যদি ভবিষ্যতে আরেকজন আসেন তার থেকে বেশি সৌভাগ্যের কথা আমাদের জন্য আর কিছু হতে পারে না।
এই নিবন্ধে বরং তার জীবনের কিছু ঘটনার কথা এখানে জানাই এবং তার সম্পর্কে অন্যান্য মনীষীরা কে কি বলেছেন সেটা লিখি। কারণ সত্যি কথা বলতে আমার মত একজন খুব সামান্য লিখিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মানুষকে নিয়ে কিছু লিখলে সেটা সত্যিই দুঃসাহসিক কাজ হয়ে যায়।
তিনি নিজের সম্পর্কে কি বলতেন সেটা প্রথমে দিয়ে শুরু করি:
"আমি টাকা অপেক্ষা, পদমর্যাদা অপেক্ষা সম্ভ্রমই বহু মূল্যবান মনে করি। যে কাজেই সম্ভ্রমের অপচয় হয় আমি সেই কাজ করতে চাইনা।"
তিনি তো দয়ার সাগর ছিলেন। ঐ বিরাট হৃদয়, ঐ তেজ...
"আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি; নিজের বা সমাজের মঙ্গলে নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক হইবে তাহা করিব ; লোকের বা কুটুম্বের ভয় কদাচ সংকুচিত হইবো না।".... ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর।।
এই নিবন্ধে বরং আমাদের জন্য অর্থাৎ নারী শিক্ষা বা নারী-জীবনের উন্নয়নের জন্য বিদ্যাসাগর কী কী করেছিলেন সেই বিষয়ে একটুখানি আলোচনা করার চেষ্টা করি।
পাঠক, একবার ভেবে দেখুন দুশো বছর আগের এই বাংলার কথা। মেয়েদের জীবন তখন পুরো অন্ধকারাবৃত। পড়াশুনা করে বড়ো হওয়া তো অনেক দূরের কথা....অক্ষর পরিচয়ও ঘটতো না..... অতি শৈশবে, পাঁচ ছ বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হতো তাদের থেকে অন্তত তিনগুন বা চারগুণ বেশী বয়সী পুরুষদের সঙ্গে। খুব স্বাভাবিকভাবেই অতি অল্প বয়সে তারা বিধবা হয়ে যেত এবং তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যেতো সমস্ত সুখ, আনন্দ। তখন থেকে তার সাদা থান, একবেলা নিরামিষ খাওয়া, মাসের নানা তিথিতে নির্জলা উপোস৷ কোনও শুভ কাজে তার ডাক নেই, কোনও উৎসবে তার প্রবেশ নেই৷ ধর্মের নামে নারীর ওপর এইসব চাপিয়ে রাখা হয়েছিল। সেই যুগে মনে করা হতো যে মেয়েরা যদি পড়াশুনা শেখে তাহলে তারা স্বেচ্ছাচারিনী হয়ে যাবে এবং স্বামীর আয়ুক্ষয় হবে। এই ভাবনার এবং এই বাল্যবিবাহ প্রথার প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
সমাজে এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন তিনি। তাঁর প্রাণ কাঁদত ছোট ছোট বাঙালি বিধবা মেয়েদের দেখে। বিধবাদের অসহনীয় দুঃখ, তাদের প্রতি এই সমাজের এবং তাদের পরিবারের অত্যাচার, অন্যায়-অবিচার, তাকে গভীর ভাবে ব্যথিত করতো। তিনি ঠিক করলেন যে এই বিধবা মেয়েদের আবার বিবাহ দেবেন। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। বিধবা বিবাহের সপক্ষে গড়ে তুললেন জনমত। পাশ করিয়েছিলেন বিধবা বিবাহ আইন। 1856 সালে ভারত সরকার বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ ঘোষণা করে। নিজের পুত্র নারায়ন চন্দ্রের সঙ্গে এক বিধবার বিবাহ দিলেন নিজে দাঁড়িয়ে। নিজের খরচে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি বহু বিধবা বিবাহ দিয়েছিলেন। এই কাজের জন্য কম আক্রমণ সহ্য করতে হয়নি তাঁকে। সমাজের উঁচু স্তরের মানুষরাও তাঁকে অনেক বিদ্রুপ করেছিলেন এবং অপমানজনক কথা বলেছিলেন।
"সৎকাজ করিবার সময় লোকে নিন্দাকে লোকের কথাকে ভুলিতে না পারিলে এ পথে যাওয়া ঘোরতর অন্যায়। আমাকে লোকেরা এতদূর নীচ কথা পর্যন্ত বলিয়া সময়ে সময়ে গালি দিয়াছে রে আমি চরিত্রহীন বলিয়া অল্প বয়স্কা বিধবাদের বাড়িতে আশ্রয় দিই।"
কিন্তু তিনি পিছিয়ে আসেন নি।
"দয়া নহে বিদ্যা নহে বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব" - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।।
ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেছিলেন যে নারীরা যদি শিক্ষিত না হয় তাহলে সমাজের প্রকৃত উন্নতি অসম্ভব। তিনি এবং ড্রিংক ওয়াটার বেথুন উদ্যোগী হয়ে কলকাতায় প্রথম মেয়েদের জন্য হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এটি প্রথম ভারতের মেয়েদের স্কুল। এই স্কুলটি এখন "বেথুন স্কুল" নামে পরিচিত। বিদ্যাসাগর ছিলেন এই স্কুলের প্রথম সম্পাদক। এরপর ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি নদিয়া বর্ধমান হুগলি এবং মেদিনীপুরে মেয়েদের জন্য 35 টি বিদ্যালয় খুলেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশের মেয়েদের পড়াশুনা শুরু হয়।
তখন তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ...
"বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হওয়ার আগে সকল বর্ণের ছাত্ররা সেখানে পড়তে পেত না। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় ও বৈদ্যরাই কেবল সুযোগ পেত। সকল বর্ণের ছাত্রেরা যাতে সংস্কৃত কলেজে শিক্ষার সুযোগ পায় অধ্যক্ষ হয়ে বিদ্যাসাগর সেই ব্যবস্থাই নিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন 'যদি এ কার্যে সিদ্ধিলাভ না করতে পারি তবে এ পথ পরিত্যাগ করব' - বিহারী লাল সরকার
স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, "শিক্ষাই ছিল তাহার জীবনের মূলমন্ত্র। ইহাই ছিল তাহার জীবনের একমাত্র সাধনা। সেই সাধনার উত্তরাধিকার আমরা লাভ করিয়াছি"...
তিনি তো মমতার সাগরও ছিলেন।
নরেন্দ্র নাথ দত্ত-উত্তরকালের স্বামী বিবেকানন্দ তখন মেট্রোপলিটন স্কুলের ছাত্র। কোন একটা মজার ঘটনায় সে একদিন ক্লাসের অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে হেসে উঠেছে।মাস্টারমশাই রাগ করে এমন ভাবে নরেনের কান বললেন যে তার কান দিয়ে রক্ত পড়তে লাগলো। সেই মুহূর্তে বই খাতা নিয়ে ক্লাসের থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে নরেন, হঠাৎ বিদ্যাসাগর এসে উপস্থিত। সমস্ত ঘটনা শুনলেন। মাস্টারমশাইকে বললেন "আমি জানতাম তুমি একজন মানুষ, এখন দেখছি তুমি একটা পশু"।
সমাজের কাজ করতে গিয়ে তাঁকে বহুবার ঠকতে হয়েছে। মিথ্যা বলেও তাঁর কাছ থেকে কেউ কেউ সাহায্য নিত। একবার একজন ধরা পড়ে যায়। বিদ্যাসাগরের সহকারি তখন তাকে বলেন "আপনাকে ভালো মানুষ পেয়ে অনেকেই ভাবে ঠকায়"। এর উত্তরে বিদ্যাসাগরের সেই মূল্যবান উক্তি "পরের সাহায্য করতে গেলে মধ্যে মধ্যে ঠকতে হয়। ঠকানোর চেয়ে ঠকা ভালো"
"তাহার জীবনের সকল কার্যেই দেখা গিয়াছে, তিনি যে চেতনারাজ্যে, যে মননলোকে বাস করিতেন, আমরা তাহা হইতে বহু দূরে অবস্থিত; তাঁহার চিন্তা ও চেষ্টা, বুদ্ধি ও বেদনা গতানুগতিকের মতো ছিল না, তাহা পারমার্থিক ছিল।
তাঁহার মতো লোক পারমার্থিকতাভ্রষ্ট বঙ্গদেশে জন্মিয়াছিলেন বলিয়া, চতুর্দিকের নিঃসাড়তার পাষাণখণ্ডে বারম্বার আহত-প্রতিহত হইয়াছিলেন বলিয়া, বিদ্যাসাগর তাঁহার কর্মসংকুল জীবন যেন চিরদিন ব্যথিতক্ষুব্ধভাবে যাপন করিয়াছেন। তিনি যেন সৈন্যহীন বিদ্রোহীর মতো তাঁহার চতুর্দিককে অবজ্ঞা করিয়া জীবনরণরঙ্গভূমির প্রান্ত পর্যন্ত জয়ধ্বজা নিজের স্কন্ধে একাকী বহন করিয়া লইয়া গেছেন। তিনি কাহাকেও ডাকেন নাই, তিনি কাহারো সাড়াও পান নাই, অথচ বাধা ছিল পদে পদে। তাঁহার মননজীবী অন্তঃকরণ তাঁহাকে প্রবল আবেগে কাজ করাইয়াছিল, কিন্তু গতজীবন বহিঃসংসার তাঁহাকে আশ্বাস দেয় নাই। তিনি যে শবসাধনায় প্রবৃত্ত ছিলেন তাহার উত্তরসাধকও ছিলেন তিনি নিজে।" - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৮২০ সালে মোট বাঙালির সংখ্যা নাকি ছিল চার কোটি। রবীন্দ্রনাথের মতে তারমধ্যে একজনই মনুষ্যপদবাচ্য - তাঁর নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, যার জন্ম ওই সালের ২৬ সেপ্টেম্বর (প্রয়াণ ২৯ জুলাই ১৮৯১)।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর সনেটে বলেছেন ...
"বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।
করুণার সিন্ধু তুমি সেই জানে মনে দীন যে দীনের বন্ধু! উজ্জ্বল জগতে
হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে"...
তাঁর সম্পর্কে কথা তো শেষ হবার নয়। কিন্তু শেষ তো কখনো না কখনো, কোথাও না কোথাও করতেই হয়। আজ, তাঁর জন্মদিন। অন্তরের সমস্ত শ্রদ্ধা নিবেদন করি এবং প্রণাম জানাই শ্রেষ্ঠ হতেও শ্রেষ্ঠতর এই মহাপুরুষের পায়ে।
তথ্যসূত্র:
বিদ্যাসাগর চরিত: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিদ্যাসাগর: বিহারীলাল সরকার
করুণাসাগর বিদ্যাসাগর :ইন্দ্রমিত্র