'নীড় ছোট, ক্ষতি নেই আকাশ তো বড়'- গানটি বহু পুরোনো হলেও যত দিন যাচ্ছে, তার উপলব্ধিও ততই বাড়ছে। তবে একটা ব্যাপার, এখন আকাশটাও ছোট হয়ে আসছে। তাইনা? নতুন করে বাড়ি বানাতে চাইছেনা আজকের প্রজন্ম। পুরোনো যৌথ পরিবার ভেঙে গেছে বেশ কিছুকাল আগে থেকেই। যদিও কেউ কেউ আজকের দিনে দাঁড়িয়েও যৌথ পরিবারের এসেন্স পেতে চাইছেন, জিইয়ে রেখেছেন সেই আমেজ, তবু সেখানেও হয়েছে ভোল বদল। একই জায়গায়, বলা ভালো একই জমির ওপর প্রত্যেক শরিক ফ্ল্যাট বানিয়ে আলাদা আলাদা ফ্ল্যাট কিন্তু একই এপার্টমেন্টে থাকছেন। খাওয়া দাওয়া সবই আলাদা কিন্তু মিলমিশ রয়েছে সকলের মধ্যেও। অনুষ্ঠানে মিলিতভাবে উদযাপন করছেন পরিবারের সকলে মিলে। এইভাবে মোটামুটি ফ্ল্যাট কালচার ঢুকেই গেছে আমাদের বাঙালিদের জীবনে।
এই কালচারের যেমন কিছু খারাপ দিক রয়েছে, তেমন কিছু ভালো দিকও অবশ্যই রয়েছে। আগে বরঞ্চ খারাপ দিক আলোচনা করে নিয়ে পরে ভালো দিকগুলোয় দৃষ্টিনিক্ষেপ করা যাক। বাড়ি ছিল আমাদের প্রাণের জায়গা। নিজেদের সম্পত্তি। নিজেরা যেমনভাবে চাইব তেমনভাবে তার ব্যবহার করব। যেখানে চাইব বাগান করব, ইচ্ছে হলে বা প্রয়োজন হলে ঘর বাড়িয়ে নেব, যেমন খুশি রং করব, যেমন খুশি তার বহিরঙ্গের রূপ দেব। থাকবে গাছ পালা, ফুলের বাগান, থাকবে পোষ্যের ছড়াছড়ি। থাকবে রোদ পোহানোর জায়গা, থাকবে চিলেকোঠা, থাকবে উঠোন, থাকবে বারান্দা। থাকবে ছাদে কাপড় শুকোনো, থাকবে পাশের বাড়ির প্রতি একটু উঁকিঝুঁকি আরো অনেক অনেক কিছু। যেটা এখন ফ্ল্যাট-এ কিছুতেই হয়না। নিজের ইচ্ছে মত কিছুই করা যায়না ফ্ল্যাট বাড়িতে। ছাদ -উঠোন তো ছেড়েই দিন। বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেছে চরমভাবে থাকা পাড়া কালচার। পাড়াতুতো ভাইবোন, রোয়াকের আড্ডা প্রভৃতি।
অনেকেই শুধু এই দিকগুলো ভেবে এখনও হাহুতাশ করেন। কিন্তু একটু যদি আমাদের মনকেও আধুনিক করে তুলি, তাহলে দেখব, একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে ফ্ল্যাট কালচারের যথেষ্ট উপকারিতাও রয়েছে। আমরা এখন সকলেই কাজের জগতে বেশিরভাগ সময় কাটাই। বাড়ির স্বামী-স্ত্রী উভয়েই রোজগেরে। বিশাল একটা বাড়ি মানেই তার যথেষ্ট রক্ষণাবেক্ষণ। আগে যেমন বাড়ির মহিলারা সেই দায়িত্ব সামলাতেন, এখন সেটা সম্ভব হয় না। কোনো সাহায্যকারীর হাতেই ছাড়তে হয় সেই দায়িত্ব। যত বড় বাড়ি হবে, ততই তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খরচ হবে। সেটা এখন অনেকেই মনে করেন অপ্রাসঙ্গিক। তুলনায় ছোট ফ্ল্যাট স্বামী-স্ত্রী মিলে গুছিয়ে সাজিয়ে পরিষ্কার করে রাখতে পারেন নিজেরাই। কাজ ও হল, একসঙ্গে কিছুক্ষণ কাটানোও হল। তাছাড়া, বাড়ির তুলনায় ফ্ল্যাট কেনার খরচও অনেক কম। রয়েছে সুরক্ষার ব্যবস্থাও। প্রতি ফ্ল্যাটেই এখন রক্ষীর ব্যবস্থা থাকে। নিজেরা সারাদিন বাইরে থাকলেও তাই চিন্তা থাকেনা বাড়ির নিরাপত্তা নিয়ে। এপার্টমেন্টের মেইন্টেনেন্সের খরচ দিয়েই তা হয়ে যায়, যেটা বাড়ির ক্ষেত্রে করতে গেলে যথেষ্ট ব্যয়বহুল। প্রতিটা এপার্টমেন্টই আজকাল সৌন্দর্যায়নের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে বাগানের শখ বা সুন্দর করে বাড়ি সাজিয়ে রাখার শখ ও মেটে। একটি এপার্টমেন্টে থাকতে থাকতে বিভিন্ন ফ্ল্যাটের মানুষদের সাথে পরিচয় হয়ে যায় এবং আস্তে আস্তে তারা সকলে পরিবারের মত হয়ে যায়। তাই আজকাল দেখা যায়, প্রত্যেক অনুষ্ঠানে সকলে মিলে উদযাপন করছে ফ্ল্যাটের সব সদস্য। তাছাড়া সব মানুষই আজকাল আন্দাজ করে নেন, তাঁদের ঠিক কতটা জায়গার প্রয়োজন। তাই তাদের সেই ফ্ল্যাট এক বেডরুমের হবে, নাকি দুই বেডরুম অথবা তিন বেডরুম তা বাছাইয়ের সম্পূর্ণ সিদ্ধান্ত থাকে গ্রাহকের। অকারনে পয়সা খরচ করতে হয়না। তাই বলাই যায়, এখন সব দিক দিয়ে আবাসন প্রকল্প অনেক বেশি স্মার্ট। কর্পোরেট ভাষায় যাকে বলে 'উইন উইন সিচুয়েশন'।