কোচবিহারের গোসানিমারিতে রয়েছে দেবী কামতেশ্বরীর মন্দির। দেবী শরৎকালে দুর্গারূপে পূজিতা হন। এছাড়াও সারা বছর ধরেই কামতেশ্বরী মন্দিরে দেবী কামতেশ্বরীর পুজো হয়। চিরাচরিত পাথরের মূর্তিতেই অকাল বোধনের সময় দেবীর পুজো করা হয়। কোচবিহার জেলার দিনহাটার এক অনন্য নিদর্শন এই কামতেশ্বরী মন্দির। মন্দিরের আরাধ্যা দেবী হলেন মা ভবানী। তাই মন্দিরটি মা ভবানীর মন্দির নামেও পরিচিত। তবে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা কে, তা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। শোনা যায়, সেন বংশের রাজা নীলধ্বজ ছিলেন মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন কামতেশ্বরীর ভক্ত। দেবীর নামের তাঁর রাজ্যের নাম হয়েছিল কামতা, রাজধানী ছিল কামতেশ্বর। সেন বংশের আরও দুই রাজা চক্রধ্বজ ও নীলাম্বর কামতাপুরের শাসন ভার সামলেছিলেন বলে জানা যায়। এক দল গবেষক বলেন, নীলাম্বর মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অন্য মতে, জনৈক কামতেশ্বর নামের অন্য এক রাজা, কামতাদেবীর ভক্ত ছিলেন। তিনিই নাকি আদি মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। হোসেন শাহের আক্রমণে এবং পরবর্তীতে ১৫৫৩ নাগাদ কালাপাহাড়ের কামরূপসহ কোচবিহার আক্রমণের সময় কামতেশ্বরী মন্দির সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। যদিও সংখ্যা গরিষ্ঠ ইতিহাসবিদদের মতে, মহারাজা প্রাণনারায়ণের শাসন আমলে কোচবিহারের অধিকাংশ মন্দির গড়ে উঠেছিল। তাই মনে করা হয়, আদি কামতেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহারাজা প্রাণনারায়ণ। গোসানিমারি মঙ্গলকাব্যে উল্লেখ রয়েছে মহারাজা কামতেশ্বরের ইষ্টদেবী ছিলেন এই ঈশ্বরী কামতেশ্বরী ঠাকুররানি।
এখন যে মন্দিরটি দেখা যায়, তার বয়সও সাড়ে তিনশো বছর ছাড়িয়েছে। ১৬৬৫ নাগাদ বর্তমান মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। শোনা যায়, রাজার আদেশে কবি মন্ডল নামে জনৈক এক ব্যক্তি মন্দির নির্মাণ কাজ করেছিলেন। মন্দিরের জন্য মহারাজা প্রচুর সম্পত্তি দানও করেছিলেন। মন্দিরের পশ্চিমদিকের প্রবেশপথের দরজার ওপরে প্রতিষ্ঠা ফলক আজও বিদ্যমান। রয়েছে নহবৎখানা। মন্দির প্রাঙ্গণ প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত। মন্দিরের উত্তর ও পশ্চিমে রয়েছে, দুটি প্রবেশ পথ। মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। প্রধান ফটক দিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতেই প্রথম দেলাভিটা, গারোদঘর এবং হোমঘরের পরেই কামতেশ্বরী দেবীর মূল পাকা মন্দির। গর্ভগৃহে কাঠের সিংহাসনে বিরাজ করেন দেবী। এছাড়া রয়েছে বিষ্ণু মূর্তি, সূর্য মূর্তি, ব্রহ্মা ও শিবলিঙ্গ। সবই পাথর নির্মিত। মূল মন্দিরের উত্তরপূর্ব কোণে রয়েছে শিবমন্দির। দেবীর সিংহাসনের উত্তরপাশে সূর্যমূর্তি এবং পৃথক চৌকিতে মহাদেব, নারায়ণ, গোপাল ও ব্রহ্মার মূর্তি স্থাপিত রয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গণের উত্তর পূর্বকোণে একটি মন্দিরে মহাদেব ও লক্ষ্মীনারায়ণ এবং দক্ষিণ পশ্চিমকোণে এক মন্দিরে তারকেশ্বর শিব বিদ্যমান। মন্দির চত্বরে রয়েছে ভোগ ঘর, হোম ঘর ইত্যাদি। মাঘ মাসে মন্দিরে বিশেষ উৎসব হয়। স্থানীয়দের বিশ্বাস, ঈশ্বরী কামতেশ্বরী ঠাকুররানি মন্দির অত্যন্ত জাগ্রত। রাজা প্রাণনারায়ণ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করলেও, তিনি কোনও মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেননি। মূর্তির পরিবর্তে কবচ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কবচ যে রৌপ্য কৌটায় রাখা ছিল, তার ওপরে ভগবতীর মূর্তি অঙ্কন করিয়েছিলেন রাজা। কৌটার ভিতরে রক্ষিত বস্তু কেউ কোনও দেখতে পাননি। পরবর্তীকালে কবচরূপী দেবী অপহৃত হলে শূন্য সিংহাসনকে পুজো করা হয়। প্রতি বছর বৈশাখ মাসে সারা মাসব্যাপী বিশেষ পুজো হয়, যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়।
মন্দিরের ইতিহাস বলছে, মন্দিরটি একসময় রাজপাটে অবস্থিত ছিল। হুসেন শাহের আক্রমণ থেকে ঠাকুররানিকে বাঁচাতে কাজলিপুরাতে মূর্তিটি লুকিয়ে রাখা হয়। মঙ্গলকাব্য অনুযায়ী, সেই কাজলিপুরাতে একটি বড় মাছ ওই মূর্তিটিকে গিলে নেয়। একদিন জেলের জালে ধরা পড়ে সেই মাছ। মাছের পেট থেকে ঈশ্বরী কামতেশ্বরী ঠাকুররানির সেই মূর্তি উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীকালে রাজা প্রাণনারায়ণ স্বপ্নাদেশ পেয়ে ওই ধীবরের থেকে মূর্তিটি উদ্ধার করেন এবং ১৬৬৫ সালে মন্দির তৈরি করে ঠাকুররানিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
রাজা প্রাণনারায়ণ মন্দিরে পুজোর জন্য সীতার জন্মস্থান মিথিলা থেকে মৈথিলী পুরোহিতদের নিয়ে এসেছিলাম। মায়ের পুজো শুরু করেন রতিনাথ ঝা। সেই থেকে মন্দিরে পৌরহিত্যের কাজে ঝা পরিবার নিযুক্ত। আজও ঈশ্বরী কামতেশ্বরী ঠাকুররানি মায়ের পুজো করে আসছেন ঝা বংশের লোকেরা। রাজার আমলে ঈশ্বরী কামতেশ্বরী ঠাকুররানিকে সন্তুষ্ট করতে দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিনে মন্দিরে মহিষ বলির প্রথা রয়েছে। অষ্টমীর দিন মহিষ বলিকে কেন্দ্র করে রাজ্যের বহু জেলা থেকে ভক্তদের সমাগম হয়।