১৭২০ সালে প্লেগ, ১৮২০ সালে কলেরা, ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু, ২০২০ সালে কোভিড-১৯…২১২০?মহান আলেকজান্ডার। শেষ যাত্রা। মৃত্যুর পর। চলেছেন অচেনা ধামের উদ্যেশে। হাত দুটো ঝুলছে কফিনের বাইরে।কারণ? এই পৃথিবীতে আপনি যখন এসেছিলেন তখন সঙ্গে আনেনই কিছুই; তাই একদম শেষে নিয়েও যেতে পারবেননা কিছুই। হিসাব তো সহজই। এরকম হিসাব ছোট্ট ছেলেমেয়েরা আকছার করে থাকে। তবে যে শিক্ষা তিনি দিতে চেয়েছেন, তার গভীরতা ধাবন করেননি কেউই।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেননি কেউই…নিলে-নিছক কাকতলীয়? না কি প্রতি একশ বছরে পৃথিবীর বুকে নেমে আসে এমনি প্রান নাশক মহামারির প্রকোপ!এই মহামারি গুলোর প্রতিটিই বিশ্ব সমাজ ব্যবস্থায় স্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল।গত ৩০০ বছরে এভাবে ধারাবাহিকভাবে মহামারি আঘাত করেছে পৃথিবীতে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগকে ‘বৈশ্বিক মহামারি’ ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। করোনাভাইরাস বিশ্বে যেমন আতঙ্ক সৃষ্টি করছে, তার চেয়ে বেশি আতঙ্ক নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিল অসংখ্য রোগ।
খুদ্র দানব। ভাইরাস। সেই আতঙ্ক সৃষ্টিতে বাজিমাত করে। শুধু বিংশ শতকেই গুটি বসন্ত প্রাণ কেড়ে নিয়েছে প্রায় ৩০ কোটি মানুষের। প্রথম কে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তা জানা না গেলেও এ পৃথিবীর সর্বশেষ আক্রান্ত ব্যক্তিটি ছিলেন বাংলাদেশের রহিমা বানু। বর্তমানে এই দানবটিকে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে।
আরও এক বিভীষিকার নাম স্প্যানিশ ফ্লু । ১৯১৮ থেকে ১৯১৯ সালের মধ্যে এ ভাইরাসের সংক্রমণে প্রাণ হারায় পাঁচ থেকে দশ কোটি মানুষ, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় তিন শতাংশ।ইতিমধ্যেই করোনা তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেখাতে শুরু করেছে। সন্ত্রস্ত ৭০০ কোটি মানুষ। কোনও সামাজিক অগ্রাধিকার, বৈষয়িক সম্পত্তি ও জাতিগত বিভেদ মানছেনা সে। মানুষও এক সুরে বাঁধতে শুরু করেছে নিজেদের। তবে সেটা কি চিরস্থায়ী?
চিরস্থায়ী নয় বলেই বোধ হয় এই ছোট ছোট দানবেরা মহামারি হয়ে ঝাঁপাতে সাহস পায়। কারণ সক্কলে। দোষী সবাই। বেঁধে বেঁধে থাকতে ভুলে গিয়েছে মানুষ। সভ্যতার আদি লগ্নে যে সুন্দর নিটোল প্রকৃতির কোল পেয়েছিল সব্বাই, নতুন ভাবে সাজিয়ে তোলার জন্যে, সেখানে মানুষই অতিরঞ্জকতার গরল ঢেলেছে।
কলুষিত করেছে এই প্রকৃতির পবিত্রতা। সেই পবিত্রতা রক্ষার্থেই মায়ের সন্তানের উপর এত অবিচার! মা অর্থে প্রকৃতি। তাঁর সন্তান মানুষ। মানুষ তো তাঁকে ভালো রাখেনি। তাই সেই আদিম নারীও আজ মুখ ঘুরিয়েছে।আজ থেকে দশ হাজার বছর আগে মানুষ যখন কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে থিতু হয়, তখনই মূলত গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় তৈরির ধারণা আরও পোক্ত হয়। আর সেই সময় থেকেই সংক্রামক রোগ মহামারিতে রূপ নিতে শুরু করে।
ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, গুটি বসন্ত প্রভৃতি বিভিন্ন রোগ নানা সময়ে মহামারির আকার নিয়েছে। মানবসভ্যতা যত উন্নত হয়েছে, মহামারির প্রাবল্য তত বেড়েছে। কারণ, ধীরে ধীরে গ্রাম থেকে গড়ে উঠেছে শহর, জনসংখ্যার ঘনত্ব বেড়েছে। এ ছাড়া বেড়েছে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ ও বাণিজ্য। ফলে রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে।
থুকিডাইডিসের রচনা থেকে জানা যায়, পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ যখন সংগঠিত হয়েছিলো গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে তখন টাইফাস মহামারিতে এথেন্সের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মারা যায়, যার কারণে স্পার্টার জয়লাভ সম্ভব হয়েছিল।একসময় দুনিয়ার বাতিঘর বলা হতো রোমকে। ১৬৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮০ খ্রিষ্টাব্দ সেই রোম মাত্র পনেরো বছরে জনমানব শূন্য হয়ে যায় গুটি বসন্তের কারণে। সে সময় রোমকে বলা হতো ভূতের নগরী। এমন কি পুরো রোমে বাতি দেওয়ার মতো একজন মানুষও জীবিত ছিল না।রাজপরিবারের সদস্যরাও এর প্রকোপ থেকে রেহাই পাননি।
তবে দেখা যাচ্ছে, মানব সভ্যতার আদিমতা যবে থেকে নোঙর করেছে আধুনিকতার দিকে- সেই থেকেই কি রেডি স্টেডি পো বলেছে মহামারির দল? তাদের আসা কি এখনও বাকি? মারভেল কমিক্সের চিত্তরি সেনাদের মত!সময় এখনই।মানব সভ্যতার চিরন্তনতা এবং সত্যতাকে টিকিয়ে রাখতে লড়াই করতে হবে দলে দলে। ভুলে যেতে হবে সব ব্যবধান। ঠিক যেভাবে ইতালির মানুষ গলা মিলিয়েছে গানের সুরে। মহামারি আটকে রাখতে পারবেনা মানব সভ্যতার জয়যাত্রা।
তবে খেয়াল রাখতে হবে, এই জয় ঘোষণায় নীরবে আক্রান্ত না হতে হয়, সেই প্রকৃতিকে। সে ভালো থাকলেই, ভালো থাকবে সভ্যতা। ভালো থাকবে আগামীর শিশু।এইভাবেই হাতে হাত রেখে এগিয়ে আসতে হবে।