৬ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা, ফোলা চোখ, পুরুষ সৌন্দর্যের কোনও সংজ্ঞাই তাঁর সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না। বলিউড খুব সহজে গ্রহণ করেনি ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার এই ছাত্রটিকে। প্যারালাল ছবির জমানা প্রায় তখন শেষ। বলিউড পুরোপুরি কমার্শিয়াল মডেলে চলছে। কিছুটা সেই জন্য ছোট পর্দায় চলে এলেন। বোম্বের মতো শহরে জীবন চালানোর জন্য যে পাথেয় দরকার তা তিনি টেলিভিশন থেকে চলে আসত। কিন্তু দিনের শেষে বেড়েই চলে অপ্রাপ্তির ভান্ডার। তবে তাঁর ধৈর্য্যের ভাঁড়ার অফুরান। চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসতেন। হাল ছাড়লেন না। একদিন চাকা অন্যদিকে ঘুরল। বলিউড তো বটেই গোটা সিনেমা বিশ্ব কাছে টেনে নিয়েছিল সেই ছেলেকে।
আসল নাম সাহাবজাদে ইরফান আলি খান। খুব প্ল্যান করে কেরিয়ার তৈরির পথে হাঁটেননি। শুরুতে ভেবেছিলেন ক্রিকেটার হবেন। তাতে বেজায় নারাজ বাবা মা। তারপর এল অভিনয়। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার স্কলারশিপ নিয়ে সোজা ফিল্ম স্কুলে।ড্রামাটিকস আর্টসে-এ ডিপ্লোমা। তার আগে অবশ্য শেষ করেছেন বিশ্ব বিদ্যালয়ের পাঠ। মুম্বইতে প্রথম জীবন শুরু করলেন এসি সারাইয়ের মিস্ত্রি হয়ে। শোনা যায় প্রথম বাড়িটাই ছিল রাজেশ খন্নার।
প্রথম ছবি ‘সালাম বম্বে’। সালটা ১৯৮৮। প্রথম ছবিই পৌঁছে দিল আন্তর্জাতিক মঞ্চে। তিনি তখনও এনএসডিতে। শেষ বছরের ছাত্র। এক সময় ভেবেছিলেন সিনেমা ছেড়ে দেবেন। তখন শুধু টেলিভিশন শো করছেন। ছবির কাজ পছন্দ মতো হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত তাঁর মত বদলান আসিফ কাপাডিয়া। ফিরে এলেন ‘দ্য ওয়ারিয়র’ দিয়ে। ২০০৫-এ কমার্শিয়াল ছবি শুরু করলেন। ছবির নাম ‘রোগ’। নামের ইংরেজী বানানে তিনি একটা বাড়তি ‘R’ যোগ করেছিলেন। সংখ্যাতত্ত্বের সংস্কারের জন্য নয়। শুধুমাত্র ‘র’ দীর্ঘ উচ্চারণ নিজের শুনতে ভাল লাগবে বলে।
দু’জন ছিল তাঁর রোল মডেল। নাসিরুদ্দিন শাহ আর ওম পুরি। খুব কম কথা বলতেন। দেখতেন আর শুনতেন অনেক বেশি। পড়াশোনা আর ছবি দেখা এই ছিল জগৎ। প্যারালাল আর মেইনস্ট্রিম এই দুয়ের মাঝখানে লড়াইটা খুব সহজ ছিল না ইরফানের জন্য।
ইরফান নিজেকে নিজে গড়েছিলেন। তিলতিল করে । কিন্তু কোনওদিনই ‘বলিউড অভিনেতা’র চেনা ছাঁচে নিজেকে ফেলতে চাননি। গ্ল্যামার দুনিয়ার মানুষ হয়েও জীবনে জল-মাটি-রোদ্দুরের গন্ধকে হারিয়ে যেতে দেননি। তাই ছুটে যেতেন মাটির মানুষদের কাছে।
অভিনয় স্কুলে তাঁর মাস্টারমশাই ছিলেন প্রসন্ন হেগেদু। ছুটে গিয়েছিলেন তাঁর বদনওয়াল গান্ধী আশ্রমে। সারাদিন ছিলেন। তারকাদ্যুতিতে নয়, সম্পূর্ণ মানবিক কর্তব্যে। দুই ছেলেকে নিয়ে যেতেন সবরমতী আশ্রমে। টান ছিল গান্ধীবাদের প্রতি।
ইরফানের জীবন লুকিয়ে ছিল তাঁর চোখে। চোখের ভাষা আর অভিব্যক্তিই তাঁকে আলাদা করে চিনিয়ে দিয়েছিল বাকিদের থেকে। আপাত নির্লিপ্ত দৃষ্টির অন্তরালে যে গভীর দীঘি লুকিয়ে থাকে ছোঁয়া সহজ নয়। সিনেমা পেরেছিল, বলিউড পারেনি।