সমাজ এখনও স্বঘোষিত 'পুরুষতান্ত্রিক' হলেও হাওয়ার সঙ্গে বদলাচ্ছে সমাজ-মানুষের গড়পড়তা দৃষ্টিভঙ্গী, জীবনযাপন। সর্বক্ষেত্রেই পুরুষদের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবন সংগ্রামে এগিয়ে চলেছে মেয়েরা। শুধু এগিয়ে চলাই নয় মেয়েরা নিজের উদ্যোগেই বদল আনছে সমাজের সামগ্রিক চিরন্তন ভাবনা চিন্তায়, রীতিমত দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে মেয়েরা, যা হওয়ারই ছিল। এই জোর দিয়ে 'হওয়ারই ছিল' বলার কারণ, দীর্ঘযুগের একচেটিয়া অবজ্ঞাই হয়ে উঠেছে মেয়েদের স্বাধিকার রক্ষা-সংগ্রামের একমাত্র উপজীব্য। ঘরে-বাইরে দু'দিক দুহাতে একাই সামলে নিচ্ছেন এখনকার 'অলরাউন্ডার' মেয়েরা। সেরকম দুই মেয়ের গল্পই আজ তুলে ধরছি এই অনুচ্ছেদে।
গতবছরই খবরে উঠে এসেছিল পুরুষদের পাশাপাশি বিভিন্ন 'ফুড' ডেলিভারি অ্যাপ(জোম্যাটো, সুইগি) এবং বিভিন্ন 'রাইডিং' অ্যাপ(ওলা, উবার) গুলি কর্মসংস্থানের দরজা উন্মুক্ত করে দিচ্ছে মহিলাদের জন্যও। সেইমত শুরুটা হয়েছিল দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই থেকে। সেখানে ফুড ডেলিভারি অ্যাপ 'সুইগি'র প্রথম ডেলিভারি গার্ল' হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন জয়ালক্ষী। তিনিই দেশের প্রথম ডেলিভারি গার্ল হিসেবে নিজের নাম নথিভুক্ত করেছিলেন। তারপর সুইগি'র তরফে জানানো হয় তাঁরা চলতি বছরে ২০০০ মহিলাকে প্রশিক্ষণ দেবেন, কথা মত কাজও করেছেন তাঁরা। আমেদাবাদ, কোচিন, কলকাতা, মুম্বই, নাগপুর ও পুনের মত শহর জুড়ে এখন কাজ করেন শতাধিক ডেলিভারি গার্ল। সুইগির পাশাপাশি এই উদ্যোগ নিয়েছে 'জোম্যাটো', 'উবার ইটস' -এর মতো অ্যাপগুলিও।
গত মাস অর্থাৎ মে-তে কলকাতায় 'প্রথম ডেলিভারি গার্ল' হিসেবে নিজের ‘উবের ইটস’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এবং নিজের নাম নথিভুক্ত করে নজির তৈরি করেছিলেন দক্ষিণ কলকাতার অরবিন্দনগরের বছর ২৬-এর মৌসুমি চ্যাটার্জি। শহরের প্রথম সার্টিফায়েড ডেলিভারি গার্ল হিসেবেও সম্মানিত হয়েছিলেন তিনি। বরাবরই অ্যাডভেঞ্চার প্রেমী ছিলেন মৌসুমি। গতে বাঁধা কাজ, চাকরি এক্কেবারে নাপসন্দ। চাকরি জীবনের শুরুটা করেছিলেন একটি টেলিকম কোম্পানিতে সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে। কিন্তু অফিসে বসে একঘেয়ে কাজ করতে একেবারেই ভাল লাগত না তাঁর। বসের গালমন্দ, অফিসের পরচর্চা, পলিটিক্স-এ যখন প্রান ওষ্ঠাগত তখনই 'উবের ইটস'-এর এহেন পরিকল্পনার কথা জানতে পারেন তিনি এবং স্কুটি চালাতে জানার সুবাদে চোখ বন্ধ করে সেখানে কাজে লেগে পড়েন তিনি। তাঁর কথায়, ডেলিভারি গার্ল-এর কাজ পাওয়াটা তাঁর কাছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ স্বরূপ। কাজের নির্দিষ্ট কোনও সময় নেই, সুবিধেমতো সার্ভিস অন করতে পারা যায়, কত জায়গায় ঘুরে বেড়ানো...নতুন নতুন রাস্তা চেনা...নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ...সব মিলিয়ে দারুণ চাকরি। পাশাপাশি ঘরে বাইরে পাচ্ছেন অফুরন্ত ভালোবাসা, সম্মান আর সমর্থন।
তাঁর কথায় এও উঠে এসেছে, "মা-বাবা কোনওদিন আমি মেয়ে বলে কোনও কাজে বাধা দেননি। এত স্বাধীনতা পেয়েছি বলেই আমার আত্মবিশ্বাসও বেড়েছে। ছেলেরা যে সব কাজ পারে, তা সব আমিও করতে পারব। প্রথম দিন খাবার ডেলিভারি দিয়েছিলেন সাউথসিটি মলে এক মহিলাকেই। মৌসুমির কথায়, "প্রথমদিনের ওই মহিলা ক্রেতা খুব আশ্চর্য হয়েছিলেন আমায় দেখে,একটা সেলফিও তুলে রেখেছিলেন! রেস্তোরাঁয় যাঁরা ডেলিভারি কাউন্টারে থাকতেন, তাঁরাও অবাক হতেন প্রথমদিকে। এখনও যখন কোথাও খাবার পৌঁছতে যাই, ক্রেতারা এগিয়ে এসে কথা বলেন দুটো, বেশি রাতের ডেলিভারিতে অনেকেই বাড়ির নিচে এসে অপেক্ষা করেন। দেখুন, ক্রেতার দরজায় পৌঁছে যাওয়ার কথা আমাদের, সেখানে যদি কেউ নিজের অসুবিধে তুচ্ছ করে মাঝরাত্তিরে আমার সুবিধের কথা ভেবে এটুকুও কষ্ট করেন, তা হলে সেটাও আমার কাছে বিরাট ব্যাপার। আমি এ পর্যন্ত কোনও অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়িনি, বরং খুব সম্মানই পেয়েছি সর্বত্র।’’
(মৌসুমী চ্যাটার্জী)
অন্যদিকে রয়েছেন মৌসুমির মতই আরেক ছকভাঙা কন্যে উত্তর কলকাতার বারাসাতের রূপা চৌধুরি। রূপা এ শহরের প্রথম মহিলা ওলা বাইক চালক। শুরুটা করেছিলেন মৌসুমির মতোই খাবার ডেলিভারি অ্যাপ দিয়ে। প্রায় একই সঙ্গে শুরু করেছিলেন দুজনে; মৌসুমি 'উবার ইটস' এবং 'সুইগি'তে যোগ দেন রূপা। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে মৌসুমির পাশাপাশি রূপাও কলকাতার প্রথম ফুড ডেলিভারি গার্ল, শুধুমাত্র আলাদা আলাদা সংস্থার জন্য নিজেদের নাম নথিভুক্ত করিয়েছিলেন তাঁরা।
(রূপা চৌধুরী)
রূপার বাবা-মা গত হয়েছেন অনেকদিন আগেই। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কও তলানিতে এসে ঠেকেছে, যত শীঘ্র সম্ভব বিবাহ বিচ্ছেদ চান তাঁরা। একটিমাত্র ছেলেকে নিয়ে আলাদাই থাকেন আপাতত এবং সংসারের হাল ধরতেই এই কাজ বেছে নিয়েছেন রূপা। সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি খাবার ডেলিভারির কাজ করে সারাদিন বেশ কিছুক্ষণ সময় পড়ে থাকে দেখে তিনি ভাবেন নির্দিষ্ট কাজের বাইরেও যদি কিছু করা যায়...তখনই তাঁর খেয়াল হয় 'ওলা' অ্যাপের কথা। তিনি জানতেন মহিলাদের নিয়োগ করে ওলা, তিনি যোগাযোগ করেন এবং পেয়েও যান সেখানে চাকরি, হয়ে ওঠেন কলকাতার প্রথম ওলা বাইক চালক। গাড়ি চালানোটা ছোটথেকেই নেশা ছিল তাঁর, ভাবতে পারেননি সেটা একদিন পেশাও হয়ে উঠবে। তাঁর কথায়, "আমি ছোটবেলায় সাইকেল চালাতে খুব ভালোবাসতাম। তারপর একদিন স্কুটি কিনলাম। স্কুটি কেনার পরের দিনই রাস্তায় চালিয়েছিলাম, কোথাও শিখতে হয়নি। আমি ড্রাইভিং করতে খুব ভালোবাসি। কখনও কাজ না থাকলে বন্ধুদের নিয়ে লং ড্রাইভেও বেরিয়ে পড়ি। তাই ভাবলাম আমার এই গাড়ি চালানোর ভালোবাসাটাকে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় সীমাবদ্ধ না রেখে যদি কোনও কাজে লাগাতে পারি।’’
চেনা ছক ভেঙে এভাবেই শহর এগিয়ে চলছে আর এগিয়ে দিচ্ছেন রূপা, মৌসুমিরা।