'তুমি তো নও যাজ্ঞসেনী,
বাঁধবে, বেণী বাঁধবে।
অশ্রু মুছে বাপের ভায়ের
পোয়ের অন্ন রাঁধবে।
কে খায়, তোমায় কে খায়,
রাক্ষসদের মরণ আছে
যজ্ঞিডালের মাথায়।
রাবণবধের তলোয়ারের
দু-কষ বেয়ে মর্চে
অনেক প্রায়শ্চিত্তের পর
ঝরছে-একটু ঝরছে !'
–অমিতাভ দাশগুপ্ত
আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। অনেকেই আজকের দিনটি নিয়ে মজা করে বলেন "নারী দ্য বস"। নির্ভেজাল একটি মজাদার মন্তব্য কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এই খুব সাধারণ কথাটির পিছনে লুকিয়ে থাকে আরেকটি করুণ নিষ্ঠুর প্রশ্ন। তা হলো তাহলে অন্য দিনগুলোয় নারীর ভূমিকা কী?
অনেক দিন আগের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবী (হ্যাঁ, তিনি তাইই ছিলেন। যদিও সে কথাটা জানলেও স্বীকার করতে ভয় পেতেন তৎকালীন পুরুষ সাহিত্যিকরা। এমন কি প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো লেখকও আশাপূর্ণা দেবীর লেখা পড়ে মন্তব্য করেছিলেন "এ তো পুরুষের লেখা!" অর্থাৎ এত বলিষ্ঠ সাহিত্য কোনো নারীর পক্ষে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়) এর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, নারীদিবস এবং নারীবর্ষ নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা।
আশাপূর্ণা অত্যন্ত আক্ষেপের সঙ্গে বলেছিলেন "একটা পুরুষবর্ষ হয় না কেন?" তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাঁকে জ্ঞাত করেছিল যে বারো মাস তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই পুরুষের। তার থেকে মাত্র একটি দিন ধার নিয়ে শুধুমাত্র নারীদের জন্য নির্ধারিত করা মানে, সমাজে নারীর স্থান যে পুরুষের থেকে নীচের সারিতে সেটা আরও বেশি করে দেখানো। এই দুনিয়ায়, সংসারে, সমাজে নারীকে অজস্র বাধার সম্মুখীন হয়ে আত্মপ্রতিরোধ তৈরি করতে হয়। তাতেও একজন স্বাবলম্বী নারীকে প্রায়শই শুনতে হয় "মেয়েমানুষের অত বাড় ভাল নয়।" সে যাক, একটা দিন তো শুধু এই অবলা নারী জাতির জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তাইই বা কম কী? আচ্ছা চলুন, সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক এই দিনটির এই বিশেষ দিনটির ইতিহাস এবং তাৎপর্য।
বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে আলাদা করে একটা দিন শুধু নারীদের জন্যই। দিনটি ৮ মার্চ–আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন দেশে এই দিনটিকে বিশেষ ভাবে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয়। তবে প্রথম নারীদিবস কিন্তু ৮ মার্চ নয়, ১৯০৯-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবার এই দিনটি উদযাপিত হয়েছিল। ১৫ হাজার নারী সেই ১৯০৮ সালে নিউ ইয়র্কের রাজপথে নেমে এসেছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল, তাঁদের কাজের সময়সীমাটা একটু কমুক সঙ্গে মজুরি সামান্য বাড়ুক।
আমেরিকার সোশ্যালিস্ট পার্টি পোশাক তৈরির শ্রমিকদের সম্মান জানাতে ১৯০৮ সালে ধর্মঘট ডেকেছিল। তাদের প্রতি সম্মান জানাতে এই দিনটি বেছে নেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে, রাশিয়ার মহিলা শ্রমিকরা ২৮ ফেব্রুয়ারি নারী দিবস উদযাপনের সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ডেনমার্কের কোপেনহাগেন শহরে ১৯১০ সালে আয়োজিত হয় একটি আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী মহিলা সংগঠনের সভা। সতেরোটি দেশের একশো জন মহিলা সেই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ইউরোপের নারীমুক্তি আন্দোলনের নেত্রী জার্মানির ক্লারা জেটলিন সেখানে ৮ মার্চ দিনটিকে 'আন্তর্জাতিক নারী দিবস' হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব দেন।
তাঁর প্রস্তাবের সমর্থনে ১৯১৪ সাল থেকে কয়েকটি দেশে নারীদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই দিনটি পালিত হতে থাকে। তবে গোটা বিশ্বে মহিলাদের অধিকারের প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জ ১৯৭৫ সালকে 'আন্তর্জাতিক মহিলা বর্ষ' হিসেবে পালন করে। ১৯৭৭ সালের রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদ ৮ মার্চ দিনটিকে 'নারী দিবস' হিসেবে পালন করার কথা ঘোষণা করে। তখন থেকেই গোটা বিশ্বে এই দিনটি ‘ইন্টারন্যাশনাল উওমেন্স ডে’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
"বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি
চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী
অর্ধেক তার নর।"
– কাজী নজরুল ইসলাম
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মধ্য দিয়ে নারীত্বের উৎসব পালিত হয়। জাতি, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে মহিলাদের কৃতিত্বকে স্বীকৃতি জানানোর জন্য এই দিনটি। এই দিনে নারী পুরুষনির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষকে নারীর অধিকার, লিঙ্গ সমতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলা হয়। যে জাতি নারীদের সম্মান করতে পারে না, সে জাতির উন্নতি অসম্ভব।
"কোন সংস্কৃতি কতটা সভ্য তা জানতে তারা তাদের নারীদের সাথে কেমন আচরণ করে সেদিকে লক্ষ্য করো।"
(If you want to know how civilized a culture is, look at how they treat its women).
–খান আব্দুল গফফর খান(Khan Abdul Ghaffar Khan) (সীমান্ত গান্ধী)
তবে আজকের দিনে মিডিয়া ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনের দৌলতে কিছুটা হলেও আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারীকে দামি দামি উপহার দেওয়ার দিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেয়েরাই অংশত: ভুলতে বসেছে এই দিনটির গুরুত্ব। কত কষ্ট সহ্য করে, কতো রক্ত, ঘাম, চোখের জল ফেলতে হয়েছে বা হচ্ছে নারীদের তার হিসেব কি আমরা রেখেছি? প্রত্যেকটি মেয়ে যেদিন স্বনির্ভর হয়ে উঠবে সেদিনই সার্থক হয়ে উঠবে এই উদযাপন। শুধু একদিন নয়, বছরের ৩৬৫ দিনই হোক নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের দিন। নারী দিবস একদিনে পালন করা সম্ভব নয়। কারণ সমুদ্রের জল কি একটা গ্লাসে ভরে রাখা যায়?