সার্কাসের রয়্যাল বেঙ্গল আর সুশীলা সুন্দরীর রূপকথা

শীতকাল। শীতকাল মানেই চারদিক কুয়াশায় ধূসর। তবুও রঙ ফুটে ওঠে কোথাও কোথাও। সেই রং-এর ভেতর লুকিয়ে থাকে জীবন। শীত পড়লেই কলকাতার মাঠে তখন বড় বড় তাঁবু পড়ত। সেই প্রায় ১০০ বছর আগেকার কথা। সেই তাঁবুতে রান্না হত হরেক রকম আনন্দ। এই আনন্দের নাম ছিল সার্কাস। সার্কাসের ইতিহাস পুরনো। নবগোপাল মিত্রের হাত ধরে বাংলায় প্রথম সার্কাস চালু হয়। তারপর ধীরে ধীরে সার্কাসের ভার হাতে নিয়ে নবগোপাল মিত্রের জামাই রাজেন্দ্র লাল সিংহ-এর কিছু অদল-বদল ঘটিয়েছিলেন। বিদেশি কয়েকজন জিমন্যাস্টকে নিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস। তবে তখনও পর্যন্ত সার্কাস দেখা যেত ঘোড়া, কুকুর এই ধরনের অপেক্ষাকৃত কম হিংস্র পশুদের। তবে মহিলাদের প্রবেশ এই জগতে মোটামুটি নিষিদ্ধ বলেই পরিচিত ছিল। মতিলাল বসুর স্ত্রী রাজবালা প্রথমবার বোসের গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসে অংশগ্রহণ করেন। তবে সে নেহাত কিছুদিনের জন্যে।

ইতিমধ্যে বদলায় পরিস্থিতি। মতিলাল বসুর হাত থেকে সার্কাসের মালিকানা যায় প্রিয়নাথ বসুর কাছে। তিনি এর নাম পাল্টে রাখেন 'প্রফেসর বোসেস গ্র্যাণ্ড সার্কাস'।

১৮৯৬ সালে প্রিয়নাথ বসুর সার্কাস দেখে খুশি হয়ে রেওয়াদের মহারাজা তাঁকে দুটি বাঘ উপহার দিয়েছিলেন। বাঘ জোড়ার নাম ছিল লক্ষ্মী ও নারায়ণ। যথেষ্ট জাঁদরেল বাঘ ছিল এরা। পোষ মানাতে হিমশিম খেতে হত সার্কাসের লোকেদের। কিন্তু এক জিমন্যাস্টের সামনে এই বাঘেরা নতি স্বীকার করত আনন্দে। পরম নিরাপত্তার আশ্রয় পেত ওই সুন্দরী মহিলা জিমন্যাস্টের কাছে।

১৯০০ সালে মেয়েরা তখনও রক্ষণশীল সমাজে অন্তঃপুরবাসনী বলেই পরিচিত। সুশীলা সুন্দরী সেই ছক ভেঙেছিলেন। বাঘের মুখে অবলীলায় হাত, মাথা ঢুকিয়ে সার্কাসে খেলা দেখাতেন সুশীলা।

প্রিয়নাথ বসুর স্ত্রী সুশীলা সুন্দরী বসু প্রথম বাঙালি মহিলা যিনি সার্কাসের সঙ্গে এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। সুশীলা সাহসী ছিলেন। বেথুন স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়েছিল। ছোট থেকেই বেশ ডাকাবুকো ছিলেন। পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া চালনা, জিমন্যাস্টিক, সব ক্ষেত্রেই পুরুষদের টেক্কা দিতেন রীতিমতো।

বাঙালিদের মধ্যে তখন শরীরচর্চা নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে। কুস্তির আখড়া তখন সবে শুরু হচ্ছে। প্রিয়নাথ বসুর আখড়াতেই প্রথম পরিচয় হয় সুশীলার সঙ্গে। বোন কুমুদিনীর সঙ্গে আখড়াতে আসতেন সুশীলা। সেই আখড়ায় কুস্তি করতে করতে সার্কাসে ঢুকে পড়া। ১৯০১ সালে প্রথমবার সুশীলা সুন্দরী এসেছিলেন বাঘের খেলা দেখাতে। কোন কাজই প্রশিক্ষণ ও অধ্যাবসায় ছাড়া সম্পূর্ণ হত না বলে মনে করতেন সুশীলা। তাই প্রশিক্ষণ নিয়েই লক্ষী-নারায়ণকে বশ করার ভার নিয়েছিলেন।

গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস-এর রিং মাস্টার বাদলচাঁদ প্রথমদিকে বাঘের খেলা দেখাতেন। পরে অবশ্য আরও অনেক পুরুষ চেষ্টা করেছেন বাঘের খেলা দেখানোর। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এইসব বাঘ থাকত চেন দিয়ে বাঁধা। তাই জীবনের ঝুঁকি থাকত না সেভাবে। কিন্তু সুশীলা সুন্দরী যখন খেলা দেখাতেন বাঘেরা থাকত বাঁধনহীন। একেবারে মুক্ত। বাঘের খাঁচায় নির্ভয়ে ঢুকে পড়তেন সুশীলা। অবলীলায় বাঘের মুখে হাত ঢুকিয়ে দিতেন। এমনকি বাঘের মুখে চুমু খেতেও ভয় পেতেন না। বাঘের সঙ্গে খোলা মঞ্চে কুস্তি করতে শুরু করেছিলেন পরবর্তীকালে, অবশ্যই খেলার অংশ হিসেবে। সেই খেলা আরো জনপ্রিয় হয়েছিল। সুশীলা সুন্দরীর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ভারতে।

কুস্তির আখড়ায় যেতেন বলে তাঁর হাতের জোর ছিল অনেকের থেকে বেশি। শোনা যায় সার্কাসে নিজেকে কবর দেওয়ার খেলা দেখাতেন সুশীলা, সেই কবরের ওপর ঘোড়ার খেলা দেখাত অন্য কেউ। তারপর সুশীলা অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসত মাটি থেকে।

সার্কাসের এই খেলা দেখানোকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন সুশীলা সুন্দরী। মৃত্যু হয়েছিল এই খেলার মাঠেই। একবার একটি ক্ষুধার্ত বাঘের সঙ্গে খেলা দেখাতে গিয়ে তার থাবায় ভীষণ আহত হয়েছিলেন সুশীলা। ‌ এই আঘাতেই মৃত্যু হয় সুশীলার। সার্কাসের রিং থেকে চিরবিদায় হয়েছিল এক সাহসিনীর। কিন্তু তাঁর কাজ আলোর মত দিশা দেখিয়েছে অনেককে। সুশীলা সুন্দরীর শরীর ও মনের জোর আজও অনুপ্রেরণা যোগায় বহু মেয়েদের।

 

 

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...