২৭ ফেব্রুয়ারি। পরিবেশ সচেতনতার অক্লান্ত যোদ্ধারা আন্তর্জাতিক মেরু ভালুক দিবস পালনে ব্রতী হয়েছেন। বহু হাজার মাইল দূরে বরফের চাদরে ঢেকে থাকা সুমেরু প্রদেশে বসবাসকারী এক প্রায় অজানা প্রাণীকে বাঁচানোর সকরুণ আর্তি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। এতো রাগের বরফ গলে জল হওয়া নয়, যাতে আবার পরিবারে শান্তি ফিরে আসবে বা অভিমান ভাঙবে। এ হলো দুনিয়ার এক আসন্ন, নিশ্চিত ভয়াবহ বিপদ- বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে মেরু-বরফের স্তর খসে খসে পড়ছে আর বরফ গলা জলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে নদী আর সমুদ্রের জলস্তর। বদলাচ্ছে হিমশীতল জলের তাপমাত্রা। চেনা পরিবেশ তাই আজ অনেকের মতো মেরুভালুকের কাছেও অচেনা হয়ে উঠেছে। কোথায় তারা আনন্দে পাড়ি জমাবে। কোথায় তাদের পর্যাপ্ত খাদ্য মিলবে! কোথায় তারা মনের ভাব আদান- প্রদান করবে আর কোনটাই বা তাদের বাসর কিংবা প্রসূতি-ঘর! সব কেমন যেন ওলোটপালট হয়ে যাচ্ছে!
মেরু ভালুকের বাস সুমেরু মহাসাগরের এবং তার পার্শ্ববর্তী সাগর ও স্থলভূমি রাশিয়ার উত্তরাঞ্চল, কানাডা,আলাস্কা, নরওয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বরনেন্টস সাগর উপকূলে, চুকচি, রাইঞ্চেল দ্বীপ, গ্রিন ল্যান্ড, ল্যাপল্যান্ডের জমিতে এরা বসতি স্থাপন করেছে। আবহাওয়া অনুকূল হলে এরা উত্তর মেরুতে পৌঁছায়। শীতে তাপ মাত্রা দাঁড়ায়- ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উষ্ণতম সময় জুলাই মাসে তাপ মাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। সারা বছর জুড়ে মেরুভালুক দেখে হারিকেন, ঘন তুষার ঝড়, বরফ বাতাস বয়ে চলে। কোনও গাছপালা নেই। সেই অঞ্চলের বরফ-পাহাড় গলছে। শিকারের অভ্যাস বদলাতে বাধ্য হচ্ছে মেরু ভালুক। টের পেয়েছে রাশিয়ার নোওয়া ফেমালুয়া অঞ্চল। দলে দলে মেরু ভালুক চলে আসছে লোকালয়ে। ভূমিতে খাবার খুঁজছে। আশঙ্কাজনক প্রজাতির ( vulnerable species) রূপে পরিগণিত হতে চলেছে মেরু ভালুক। এদের উনিশটি গোষ্ঠীর মধ্যে আটটির সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। শিকার ও চোরাশিকার এর অন্যতম কারণ। মেরু ভালুক সুমেরু মহাসাগরের বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যের সূচক। ভালো নেই মেরু ভালুকরা। আর তাই সহজেই অনুমেয় সুমেরু মহাসাগরের অবস্থাও।
সত্যজিৎ রায়ের লেখা ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ গল্পে ভিনগ্রহের বাসিন্দা বঙ্কুবাবুকে জিজ্ঞাসা করেছিল- ‘এমন কোন জায়গা বা দৃশ্য আছে যা তোমার দেখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু হয়ে ওঠে না?
উত্তরে বঙ্কুবাবু বলেছিলেন, অনেক কিছুই তো দেখিনি, ধরুন গরমের দেশের মানুষ, তাই নর্থ পোলটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।
অ্যাং একটা ছোট কাঁচ লাগানো নল বার করে বঙ্কু বাবুর মুখের সামনে ধরে বলল, ‘ এইটেয় চোখ লাগাও’।
চোখ লাগাতেই বঙ্কু বাবুর গায়ে কাঁটা উঠল। এ কী সম্ভব!
তাঁর চোখের সামনে ধূ-ধূ করছে অন্তহীন বরফের মরুভূমি, তার মাঝে মাঝে মাথা উঁচিয়ে আছে পাহাড়ের মতো এক একটা বরফের চাঁই। উপরে গাঢ় নীল আকাশে রামধনুর রঙে রঙীন বিচিত্র নকশা সব ক্ষণে ক্ষণে রূপ পাল্টাচ্ছে- অ্যারোরা বোরিয়ালিস। ওটা কী? ইগলু! ওই পোলার বিয়ারের সারি...।
আসুন দেখে নেওয়া যাক, এই অত্যাশ্চর্য প্রাণীটিকে ঘিরে কিছু চমকপ্রদ তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
ভালুক প্রজাতির মধ্যে সব চেয়ে বড় এবং এই গ্রহের মধ্যে বৃহত্তম স্থলবাসী মাংসাশী প্রাণী মেরু ভালুক। ১৯৬০ সালে আলাস্কায় একটা মেরু ভালুক শিকার করা হয় যার ওজন ছিল ২২০৯ পাউন্ড এবং পিছনের পায়ের উচ্চতা ছিল ১১ ফুট ৩ ইঞ্চি। একটি পূর্ণ বয়স্ক মেরু ভালুকের ওজন হয় ৩০০- ৭০০ কেজি। পুরুষদের ওজন মহিলাদের ওজনের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে থাকে।
এদের সাদা লোমের নিচে থাকা চামড়াটি মিশমিশে কালো, যা এদের নাক ও তার চারপাশের রং দেখে বোঝা যায়। সুমেরুর হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় সৌর রশ্মি শোষণ ও দেহ গরম রাখার এক আশ্চর্য কৌশল।
মেরু ভালুকের গায়ের লোম ফাঁপা এবং স্বচ্ছ। দৃশ্যমান আলোককে প্রতিফলিত করে। লোম সাদা দেখায় এবং তার মধ্য দিয়ে মেরু ভালুকেরা পরিবেশের তুষারের সঙ্গে যেন একীভূত হয়ে যায় এবং আত্মগোপন করতে পারে। শিকার বা শিকারী উভয়ের পক্ষেই তাকে সহজে দেখা সম্ভব হয় না।
- জীবনের বেশিরভাগ সময় সুমেরু মহাসাগরে কাটানোর সুবাদে এদের সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী হিসেবেই গণ্য করা হয়। সমুদ্রেই এদের বসবাস, ভ্রমণ এবং শিকার।
- এদের লম্বা, পুরু, বাঁকানো, ধারালো নখ শিকার ধরতে এবং খেতে সাহায্য করে।
- একবারে একটি মেরু ভালুক ২০ কেজি পর্যন্ত মাংস খেতে পারে।
- মেরু ভালুকের জল খাওয়ার প্রয়োজন হয় না। প্রানী উৎস থেকে এরা প্রয়োজনীয় তরল পায়।
- ঘাম হয় না বলে মেরু ভালুক কখনই তার আর্দ্রতা হারিয়ে ফেলে না।
- শীতের সময় এরা শরীরের চর্বি স্তরকে বাড়িয়ে নেয়।
- শিকার করে খাওয়ার সময় আসা মানেই মেরু ভালুকের জীবনে দুঃখের সময় ঘনিয়ে আসা। শিকারে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার হারই বেশি ( প্রায় ৯৮% )। সাধারণভাবে সীল এদের প্রধান খাদ্য। কখনও কখনও এরা ছোট ছোট স্তন্যপায়ী, পাখি ও তাদের ডিম খেয়ে থাকে।
- খাদ্য সংগ্রহের অভিযানে নামলে এরা অক্লান্ত সাঁতারু। খাদ্যের খোঁজে এরা একটানা বহুদিন কোনও বিশ্রাম ছাড়াই সাঁতরাতে পারে। এ কারণে এদের ‘ মাইকেল ফেল্পস ‘ বলা হয়। এদের সামনের পায়ের থাবা ( আংশিক লিপ্তপদ ) সাঁতার কাটার সময় প্যাডেলের কাজ করে সাঁতরানোর সময় পেছনের পা’কে এরা রাডারের মতো ব্যবহার করে।
- মেরু ভালুকেরা তাদের বলিষ্ঠ পায়ে বরফের উপর দিয়ে প্রচণ্ড জোরে দৌড়তে পারে ( ২০/২৫ মাইল / প্রতি ঘণ্টায় )। সামান্য উঁচু নীচু পায়ের পাতা এবং ধারালো নখ এ-কাজে তাদের সাহায্য করে। শরীরের ভারসাম্য রক্ষায় তাদের পা যেন বরফে হাঁটার জুতো।
- মেরু ভালুকেরা যখন যে পথে হেঁটে যায়, সেই পথেই তারা রেখে যায় তাদের ঠিকুজিকোষ্ঠী। তাদের পদচিহ্ন আঁকা বরফ সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে ওই বরফ গলিয়ে ও বরফগলা জল পরিশ্রুত করে বিজ্ঞানীরা তাদের চামড়ার কোষ সংগ্রহ করে তার থেকে ডি এন এ সংগ্রহ করেন এবং এভাবেই তাদের সম্বন্ধে অনেক অজানা তথ্য জানার চেষ্টা করেন।
- মেরু ভালুকেরা বহু দূর থেকে গন্ধ শুঁকে তাদের শিকারকে শনাক্ত করতে পারে। এমনই প্রবল এদের ঘ্রাণশক্তি। তিনফুট ঘন বরফের নীচে থাকা সীলকে এরা গন্ধ শুঁকে খুঁজে বের করে।দেখা গিয়েছে, ২০ মাইল দূরে থাকা সীলকেও এরা ঠিক গন্ধ শুঁকে খুঁজে বের করে ফেলেছে।
- মেরু ভালুকেরা বড়ো নিঃসঙ্গ। কারণ জীবনের অধিকাংশ সময়ই এরা একাকী। প্রজনন ঋতুতে এবং সন্তানকে বড়ো করে তোলার সময় এরা যূথচারী হয়।
- এদের স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর। আমাদের অনেকের মতো পথভোলা বা ভুলো মনের নয়। বহুবছর পর দেখা হলেও এরা একে অন্যকে ঠিক চিনতে পারে।
- বড়ো ধরনের শিকার ধরতে এদের কাঁধের সুগঠিত, স্ফীত পেশি অত্যন্ত কাজে আসে।
চিরতুষারের রাজ্যে বসবাস মেরু ভালুকের কাছে কোনও সমস্যা নয়। বরং এদের সমস্যা হল – দেহ অতিরিক্ত উষ্ণ হয়ে উঠলে তাকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। বরফের উপর সে কারণেই তারা এমন গতিতে হাঁটে বা দৌড়য়, যাতে দেহ খুব গরম না হয়ে যায়। শরীরের অতিরিক্ত তাপবৃদ্ধির ফলে মেরু ভালুকের মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে।
মেরু ভালুকের গর্ভাবস্থার সময়কাল তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ। সাধারণত বসন্তকালে তারা সন্তান প্রসব করে, যাতে আগামী শীতের আগে প্রচুর খাবার খেয়ে শাবকেরা হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠতে পারে। মা মেরু ভালুকেরা বাচ্চাদের বরফ গুহায় রেখে লালন-পালন করে এবং মাতৃদুগ্ধ পান করায়।
মেরু ভালুকের চামড়ার নীচে থাকা চর্বির স্তর প্রায় ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পুরু হয়। এই ফ্যাটের স্তর যেমন একদিকে তাদের ঠাণ্ডার হাত থেকে রক্ষা করে, অন্যদিকে তাদের জলে ভেসে থাকতে সাহায্য করে।
সাসকেট শেওয়ান বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৪ সালে তাদের থার্মোস্ট্যাটের কাঁটা গ্রীষ্মকালে ২ ডিগ্রি বাড়িয়ে এবং শীতকালে ২ ডিগ্রি কমিয়ে রাখবে বলে ঘোষণা করেছিল। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় ২০০০ টন কার্বন নিঃসরণ কম হতে পারে বলে মনে করা হয়েছিল। এর ফলে প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০০০ ডলার আর্থিক সাশ্রয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়। বাড়িতে, কর্মস্থলে, বিদ্যালয়ে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা এই ‘থার্মোস্ট্যাট চ্যালেঞ্জ’ গ্রহণ করে আমাদের কার্বন ফুট প্রিন্টের মাত্রা কমিয়ে আনতে পারি।
শক্তিকে কীভাবে সর্বোচ্চ মাত্রায় কার্যকরীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং যাতে এর অপচয় কে একেবারে কমিয়ে আনা যায় বা বন্ধ করা যায় – সে বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলা একান্ত জরুরি।
জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহারকে কীভাবে কমানো যায় বা তার দহনের কার্যকারিতা কীভাবে বাড়ানো যায়; একবিংশ শতাব্দীর মানুষ কীভাবে বিকল্প শক্তি ব্যবহারে উদ্যোগী ও পারঙ্গম হয়ে উঠতে পারে- এ বিষয়ে বিশ্বের সর্বত্র সেমিনার, ওয়ার্কশপ, পোস্টার প্রতিযোগিতা এবং জীবনকুশলতার বিকাশ ঘটে- এমন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা প্রয়োজন। সকলকে যদি জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার কমানো এবং পুনঃনবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়;তাহলেই কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমন কমবে, কমবে উষ্ণায়ন,বাঁচবে মেরু ভালুক।
এরকম একটি রাজকীয় প্রাণী আজ মানুষের করুণার পাত্র। বড়ো বিপন্ন হয়ে পড়েছে তারা। স্থানীয় অধিবাসীরা নিয়মিত তাদের শিকার করে এবং মাংস খায়। ভালুকের পুরু লোম বা চামড়া দিয়ে পোশাক আর জুতো বানায়। চর্বি দিয়ে বাড়িতে আলো জ্বালায়। মানুষ নিজে শান্তিতে থাকতে পারে না, অন্যদেরও সে স্বস্তিতে থাকতে দেয় না। শৈত্য বাড়ে মানুষের সম্পর্কে, আর উষ্ণতা বাড়ে প্রকৃতিতে।মেরু ভালুক শৈত্য চায়। উষ্ণতার বাড়বাড়ন্ত তার জীবনযাপনকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
মানুষের প্রতিদিনের নির্বিচার জ্বালানী দহনের ফলে পরিবেশে বাড়ছে কার্বন নিঃসরণ। এই কার্বনই পরিবেশে গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন ডাই অক্সাইড রূপে নির্গত হয়। কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস তাপ ধরে রেখে পরিবেশকে ক্রমাগত উষ্ণ করে চলেছে। উষ্ণতার এই ক্রমবর্ধমান মাত্রা প্রতি বছরই মেরু প্রদেশের বরফকে গলিয়ে চলেছে। মেরু ভালুকের আজ তাই প্রধান সমস্যা বাসস্থান সংকোচন, খাদ্যাভাব,খাদ্যের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা, দেহে তাপ ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় চর্বির মাত্রা হ্রাস, প্রধান খাদ্য সীল শিকার করার জন্য পারিপার্শ্বিকতার একান্ত অভাব। আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে মেরু ভালুকের সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস পাবে এবং ২১০০ সাল নাগাদ এরা অবলুপ্ত হয়ে যাবে।
তবে কি মেরু ভালুক অচিরেই অন্য বহু প্রাণীর মতোই বিলুপ্ত, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? ঠাঁই পাবে ইতিহাসের পাতায়? তলিয়ে যাবে বিস্মৃতির অন্তরালে? আমরা কি তা হতে দেব? এ সব মরমী প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আন্তর্জাতিক মেরু ভালুক দিবস উদ্যাপন। মেরু ভালুককে সংকট থেকে রক্ষা করা এবং তাদের সম্মন্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে ‘ Polar Bears International ‘ ২৭ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘ আন্তর্জাতিক মেরু ভালুক দিবস ‘ ( International Polar Bear Day ) হিসেবে ঘোষণা করেছে।