"যে ভাষায় হয়ে প্রীত, পরমেশ-গুণ-গীত,
বৃদ্ধকালে গান কর মুখে।
মাতৃসম মাতৃভাষা, পুরালে মনের আশ,
তুমি তার সেবা কর সুখে।।"
(‘মাতৃভাষা’ কবিতা- ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)।
বাংলা সাহিত্য যখন মঙ্গলকাব্যের ধারা আর ঈশ্বরের গুণগাথা ছেড়ে আধুনিক সামাজিক সমস্যা ও সঙ্কটকে বিষয় করে নিচ্ছে, তখন মাতৃভাষা বাংলাকে বন্দনা করে এই ‘মাতৃভাষা’ কবিতাটি লিখেছিলেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত। তখনকার ভাষাসঙ্কট ছিল অন্যরকমের।
ঔপনিবেশিক বাংলায় সুলতানি আমলে ফারসি ভাষা, ফরাসি অধ্যুষিত অঞ্চলে ফরাসি ভাষা আর ইংরেজযুগে ইংরেজি ভাষা হয়ে উঠেছিল কাজ জোটানোর সহায়। উনিশ শতকে এসে সদ্য জাতে ওঠা ‘বাবু’ সম্প্রদায় ও নব্য শিক্ষিত কিছু যুবক ব্যাপক উন্নাসিকতা দেখাতে শুরু করলেন মায়ের ভাষা বাংলার প্রতি। তবু, সে শুধু কেবল সম্প্রদায়গত উন্নাসিকতাই ছিল। আর কিছু না।
বাঙালি আর বাংলাভাষার প্রতি প্রথম রাজনৈতিক চক্রান্ত শুরু হল, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। বেড়ালের সেই পিঠে ভাগ করার খেলা বন্ধ হয়েছিল অনেক অসহযোগ ও সত্যাগ্রহের ভেতর দিয়ে। তবে লখীন্দরের বাসরে ছিদ্রটি বজায় রাখার জন্য শুধু বাংলা ভাষাভাষীদের দুটি জেলা, মানভূম ও ধলভূম বিহার ও উড়িষ্যার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল।
১৯৩৫ থেকে শুরু হয়ে গেল মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ওপর সরকারিভাবে হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত। রাজনৈতিক সুবিধালাভের জন্য বাঙালি-বিহারি সাম্প্রদায়িকতাকে উসকানি দেওয়া শুরু হল। ডঃ রাজেন্দ্রপ্রাসাদের নেতৃত্বে বিহারিদের নিয়ে ‘মানভূম বিহারি সমিতি’ গড়ে উঠল আর বাঙালিদের জন্য ব্যারিস্টার পি আর দাস ‘মানভূম সমিতি’ গড়ে তুললেন।
১৯৪৮-এ বিহার সরকার ঘোষণা করলেন, যে-সব স্কুল সরকারি সাহায্য পায়, সেখানে বাংলা পড়ানো যাবে না। স্কুলের সাইন বোর্ড বাংলায় নয়, হিন্দিতে লিখতে হবে। স্কুলের প্রার্থনা-সঙ্গীত বাংলা নয়, হতে হবে হিন্দি ‘রামধুন’। চলল বাংলা ভাষাকে সরকারিভাবে বাঙালিদের কাছে ব্রাত্য করে দেওয়ার সব রকমের প্রস্তুতি।
উল্টোদিকে শুরু হল, মানভূমের অগণিত বাংলাভাষী মানুষের সম্মিলিত ও সংগঠিত হয়ে মাতৃভাষার অধিকারে আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি। মানভূমের জননেতা অতুলচন্দ্র ঘোষ ও নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্তের নেতৃত্বে শুরু হল সত্যাগ্রহ আন্দোলন। সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মানুষের গণসঙ্গীত হয়ে উঠল মানভূমের মাটির গান, টুসুগান। সংগ্রামী কবি ভজহরি মাহাত গান বাঁধলেন,-
‘শুন বিহারি ভাই,
তোরা রাখতে নারবি ডাঙ্গ দেখাই।
তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি
বাংলা-ভাষায় দিলি ছাই।’
আন্দোলনের নাম হল ‘টুসু সত্যাগ্রহ’। সেই আন্দোলন সমর্থনে এগিয়ে এল বাংলার প্রতিটি সংবাদপত্র এবং সমসময়ের বুদ্ধিজীবীরা। দীর্ঘ লড়াইয়ের পথে পুলিশি-নির্যাতন আর কারাবরণের মধ্য দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে লাগল এই অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন। অবশেষে কেন্দ্র সরকারের হস্তক্ষেপে ১৯৫৬ সালে ‘মানভূম’ থেকে পুরুলিয়া জেলা তৈরির মধ্য দিয়ে এই আন্দোলন শেষ হয়। এই অঞ্চলের বিপুল মানুষের মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলা ভাষার ওপর অন্য ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতি কিন্তু সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। আমাদের পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের হাতে পড়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ হয়েছিল। সেখানকার মানুষের ওপর জোর করে তারা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল উর্দু ভাষা। বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি আবুল বরকত, রফিক উদ্দীন আহমদ আর আব্দুল জব্বারের আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে চলে দীর্ঘ লড়াই। অবশেষে বিপুল জনমতের চাপে পাকিস্তান তার ‘উর্দু’-নীতি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ‘বাংলা’ হয় পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
তারপর ১৯৬০ সালে বরাক উপত্যকার মানুষের ওপর অসমীয়া ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ব্যাপক গণসংগ্রাম গড়ে ওঠে। ১৯৬১ সালের ১৯ মে এগারো জনের আত্মাহুতির পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
বাংলা ভাষা এমন একটি ভাষা, যাকে আপন করে রাখার মরণপণ লড়াইয়ে অগণিত মানুষ শামিল হয়েছেন, শহিদ হয়েছেন। অর্জন করেছেন পৃথিবীর প্রথম ভাষা-শহিদের স্বীকৃতি। সেই ভাষা শহিদদের সম্মানে আজ ২১ ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলা ভাষার মুক্তি দিবস নয়, সমস্ত পৃথিবী নতমস্তক হয়ে গ্রহণ করেছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে।