নারী পাচার। খুব চেনা শব্দ। কিন্তু ‘পুরুষ’ পাচার?
মানতে দ্বিধা নেই, খুব পরিচিত নয় এই শব্দ। খবরের কাগজের হেডিং বা প্রাইমটাইমের নিউজফিড, কোথাও সেভাবে আলদা করে কানে উঠে আসে না, কিন্তু তা তাতে ম্লান হয়ে যায় না ঘটনার অস্তিত্ব।
বিষয় যখন ‘মানবপাচার’, তখন আর তা কেবল নারী বা শিশু কেন্দ্রীক এক তরফা শব্দ হয়ে থাকে না। অপরাধের দুনিয়ায় শব্দটি কোন লিঙ্গ বৈষম্য রাখেনি। তার শিকার হয়ে দাঁড়ায় লিঙ্গ নির্বিশেষ।
বহু বছর ধরেই যার শিকার পুরুষরাও। মানব পাচারে পুরুষের পরিসংখ্যান সেভাবে ‘রাডার’-এ ধরা পড়ে না। আলোচনার অলক্ষ্যে থেকে গিয়েছে। নারীদের মতোই মানব পাচার চক্রের ‘টার্গেট’ কিশোর এবং যুবকরা। বালকরাও ছাড় পায় না। অপহরণ করে বিক্রি করে দেওয়া হয় দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপ এবং বিভিন্ন ইসলামপ্রধান দেশে।
কখনও ক্রীতদাস কখনও সস্তার শ্রমিক কখনও বা যৌন পেশার কাজে বিক্রি করে দেওয়া হয় তাদের। আরব, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মধ্যযুগীয় ক্রীতদাসদের সঙ্গে তাদের জীবনের বিশেষ তফাৎ নেই।
আফ্রিকায় চলে বালকপাচার। কঙ্গো সুদানের মতো দেশগুলোকে এ ব্যাপারে হটস্পট বলা যায়। দরিদ্র আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শিশু, স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে মাঝে মাঝেই হারিয়ে যায়। বেশির ভাগ ঘটনাতেই তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায় না। বেশি খোঁজ করতে গেলে বিপদে পড়তে হয় পরিবারকে। সন্তানের খোঁজ করতে গিয়ে অজানা আততায়ীর হাতে অভিভাবকের প্রাণ দেওয়ার ঘটনাও আছে। অপহরণ করা হয় সদ্য বাইরের জগত দেখতে শেখা এই সব শিশুদের। রাতারাতি পণ্য হয়ে পৌঁছে যায় ‘হটস্পট’ অঞ্চলে। যে হাত একদিন বই-কলমে মেতে থাকত, রঙ পেন্সিলের রঙে রাঙিয়ে তুলত ড্রইং খাতার ফুল, সেই হাতেই তুলে দেওয়া হয় বন্দুক। আগ্নেয়াস্ত্র সামলানোর ট্রেনিং দেওয়া হয় গোপন আস্তানায়। রক্ত-হিংসা আর ভয়ের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে তারা।
এছাড়া পুরুষ পাচারের আরও একটি কারণ ‘শিশু দত্তক বন্দোবস্ত’। নিতান্ত পারিবারিক বা উত্তরাধিকার সংক্রান্ত কারণে অনেক ধনী পরিবারে ‘শিশুপুত্র’ দত্তক নেওয়া হয়। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের থেকে শিশুর জন্মে পরেই ভয় বা লোভ দেখিয়ে কিনে নেওয়া হয় শিশু। সদ্যজাত বা কয়েকমাস বয়সী শিশুপুত্রের চাহিদা আকাশছোঁয়া, সেই অনুযায়ী চাহিদা কম, তাই আগ্রাসী বাজারে ‘পুত্র’ বিকোয় চড়া দামে।
নারী পাচার বা শিশু পাচার যতটা সামনে আসে ‘পুরুষ-পাচার’-এর বিষয়টি ততটা আলোচনায় আসে না। এর পশ্চাতে দুটি কারন। প্রথমত, ‘সেলফ ডিনায়াল’ এবং ‘ভিকটিম ব্লেমিং’ একটা বড় কারণ। যারা এই দুই বাধা কাটিয়ে প্রকাশ্যে আনে নিজেদের সঙ্কট তাদের আবার অন্য সমস্যায় পড়তে হয়। যেভাবে পাচার হওয়া একটি মেয়ে ‘একঘরে’ হয়ে যায় অনেকটা সেভাবেই কোনঠাসা হতে হয় ‘মেল ভিকটিম’কেও। মূলস্রোতে ফেরা কঠিন হয়ে যায়। সুস্থ-স্বাভাবিক কর্মসংস্থান কঠিনতর।
নারী পাচার কাহিনী যত সহজে বিশ্বাস করে সমাজ, পুরুষদের কাহিনী গ্রহণ করতে ততটাই অবিশ্বাস কাজ করে। এমনকি নিজের পরিবার, পরিজন বা বন্ধুরাও মানতে নারাজ। ঝকঝকে চেহারা, 'জিম টোন্ড বডি' দেখে তারা ভাবতেই পারে না যে এমন বহিরঙ্গের আড়ালে জোর করে ‘যৌন শ্রমিক’ বানিয়ে দেওয়ার হাড় হিম ঘটনা লুকিয়ে আছে। বলিষ্ঠ পৌরুষের বর্মে ‘ভিকটিম’-এর নিয়তি শুধুই ‘ভিকটিম’ হয়ে যাওয়া। কণ্ঠ হয়ে ওঠার স্পর্ধা হারিয়ে যায় পরিত্যক্ত হওয়ার অসহায়তায়।
তবে এই পরিস্থিতিতে খানিক বদল আসতে শুরু করেছে। বিশ্বজুড়ে ‘মেল সারভাইভার্স’দের জন্যও নেওয়া হচ্ছে বিশিন্ন সচেতনতা কর্মসূচি। শিশু এবং মহিলাদের মতোই পুরুষদের জন্যও শেল্টার এবং সেফ হোম গড়ার উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো। তাদের আইনি সহায়তাদান এবং মূলস্রোতে ফেরানো এই দুই লক্ষ্য। অনলাইনেও চলছে সচেতনতা প্রচার।
নারীদের পণ্য হয়ে ওঠার কাহিনী বহু চেনা। চর্চিত সেই কাহিনীর অলি-গলি, রাজপথ। কিন্তু পুরুষের পণ্য হয়ে ওঠার গল্প আজও অচেনা। পর্দার আড়ালে পৌরুষের দম্ভে যাকে ঢাকা দিয়ে রাখতে শেখায় পুরুষের মান। পুরুষের তৈরি ইগো। তাই চিৎকারগুলো শোনা যায় না। কান্নাগুলো দেওয়াল গাঁথা। কিন্তু নির্যাতিতের লিঙ্গভেদ থাকলেও নির্যাতনের লিঙ্গভেদ থাকে না। ঠিক চাবুক আর চাবুকের দাগগুলোর মতোই তারা এক...চোখের জলের রঙের মতোই অভিন্ন... কোথায় পুরুষ, কোথায় নারী, শুধুই মানুষ...