আস্থা যাঁদের 'বামপন্থা'য়

আজ বিশ্ব বাঁ-হাতি দিবস। হ্যাঁ ঠিকই, পড়ছেন আজ বাঁ-হাতিদেরই দিন। যাঁরা বাঁ-হাতে লেখেন, যাঁদের আমরা গোদা বাংলায় ল্যাটা বলি, সেই লেটুবাবুদের জন্যেই আজকের দিনটি। কিন্তু হঠাৎ করে এমন দিন উদযাপন করা শুরু হল কেন?

১৯৭৬ সালেই প্রথম আন্তর্জাতিক বাঁ-হাতি দিবস পালন করা হয়েছিল। শুরু করেছিলেন, জনৈক ডিন আর ক্যাম্পবেল। তিনিই ‘লেফ্টহ্যান্ডার্স ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৭৬ থেকেই প্রতি বছর ১৩ আগস্ট পালিত হয়ে আসছে এই দিবসটি।

এই দিন পালনের নেপথ্যে রয়েছে, এক বৃহৎ উদ্দেশ্য। কী সেই নেপথ্য কারণ, জানতে হলে আমাদের খানিক পিছিয়ে যেতে হবে।

১৮৬০ সাল নাগাদ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ মানুষ ছিলেন বাঁ-হাতি এবং ১৯২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ শতাংশে। আজকে একবিংশ শতকে তা পৌঁছে গিয়েছে ১০ শতাংশে। প্রাচীনকাল থেকেই বাঁ-হাতি মানুষদের নিয়ে সমাজে নানা মিথের প্রচলন ছিল। বিশ্বব্যাপীই কিছু না কিছু বদ্ধমূল ধারণা, কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। নানা সময়েই সামাজিক অপবাদ, অন্ধবিশ্বাস ও নানান রকমের বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বাঁ-হাতি মানুষেরা।

Lefthanders1

একসময় সারা পৃথিবীতেই তাঁদের অশুভ ভাবা হত। যদিও এই বিভ্রান্তির জন্যে ভাষা অনেকাংশে দায়ী। লাতিন শব্দ ‘sinister’-এর অর্থ হলো বাম। প্রাচীন কালে এই শব্দটিকে ব্যবহার করা হতো দুর্ভাগ্য নিয়ে আসা সূচক শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে। রাইট শব্দের অর্থ হল ঠিক এবং ডান দিক। প্রাচীন ইউরোপে শুধু এই কারণেই বাঁ-হাতিদের ভুল বা বেঠিক মনে করে অবহেলা করা হতো।

প্রাচীন মিশরে বাঁ-হাতিরা কখনোই পৌরহিত্য করতে পারতেন না। ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়েও বাঁ-হাতিদের নিয়ে নানান সময়ে নিয়ে নানা ধর্মীয় কুসংস্কার প্রচলিত ছিল।আজও বাঁ-হাতিদের নানান অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। দৈনন্দিন ব্যবহারের অধিকাংশ জিনিসপত্রই ডানহাতিদের ব্যবহারের পক্ষে উপযোগী হিসেবে তৈরি করা হয়। এ জন্য গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে স্টিয়ারিং, দরজার লক, দরজার পাল্লা, হাতল ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করতে সমস্যায় পড়েন বাঁ-হাতিরা।

যাঁরা বাঁ-হাতি হয়ে জন্মগ্রহণ করেন, ছোট থেকেই তাঁদের যেকোন কাজ করার ক্ষেত্রে প্রতিবর্ত ক্রিয়ার নিয়মেই বাম হাত অগ্রাধিকার পায়। কিন্তু প্রতিবেশী আত্মীয় পরিজনদের বাঁকা দৃষ্টির কথা ভেবেই বাবা মায়েরা ডান হাত ব্যবহার করতে সন্তানকে উৎসাহিত করেন। কখনো কখনো বাধ্যও করেন। এতে শিশুদের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। সত্যি বলতে, জন্মের পরেই তো বোঝা যায় না, কে বাঁ-হাতি হবেন আর কে ডান-হাতি। সময়ের সঙ্গে কোন হাত বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে, শিশু কোন হাতটিকে এগিয়ে দিচ্ছে, তা দেখেই বুঝতে হবে। সে কোন হাত ব্যবহার করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে।

স্কুল-কলেজেও সহপাঠি-বন্ধুদের থেকে বাঁ-হাতিদের নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ শুনতে হয়। গোটা পৃথিবীর চিত্রটাই এমন।
তাই বাঁ-হাতি দিবস পালনের মুখ্য উদ্দেশ্য হল বাঁ-হাতিদের নিয়ে বিভিন্ন রকমের কুসংস্কার এবং যাবতীয় ভুল ধারণা ভেঙে দেওয়া। বাঁ হাত যাঁরা ব্যবহার করেন, তাঁরা কোনোভাবেই অস্বাভাবিক নন, এই বার্তাটি দিতেই দিবসটির সূচনা হয়েছে। বাঁ-হাতিরা মস্তিষ্কের ডান দিকটি বেশি ব্যবহার করেন। ডান-হাতিরা ঠিক উল্টোটা করেন, তাঁরা মস্তিষ্কের বাম দিকেই বেশি কাজে লাগান।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে বাঁ-হাতি হওয়ার প্রবণতা বেশি। কিন্ত বাঁ-হাতি হওয়ার বৈজ্ঞানিক কারণ কী?

গবেষণা অনুযায়ী, সুনির্দিষ্ট জিনের কারণে, জন্মের সময় শিশুর ওজন, মায়ের বয়স, নির্ধারিত সময়ের আগেই জন্ম হওয়া, গর্ভাবস্থায় আল্ট্রাসাউন্ড সহ একাধিক কারণে শিশু বাঁ-হাতি হতে পারে। বাঁ-হাতি হওয়ার কারণ হিসেবে দায়ী প্রায় ৪০টি জিনকে শনাক্ত করেছেন গবেষকেরা। প্রচলিত আরেকটি গবেষণা অনুযায়ী, জন্মগ্রহণের সময় প্রায় ৭৫ শতাংশ শিশুই বাঁ-হাতি হওয়ার বৈশিষ্ট্য নিয়েই জন্মায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও জীবনযাপনের পদ্ধতির কারণে শিশুটি ডানহাতিতে পরিণত হয়।

Lefthanders2

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীরবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. টিম ক্রোর-এর মতে, সম্ভবত মানবদেহের পিসিডিএইচ-১১এক্স জিন আমাদের হাতের ব্যবহারের বিষয়টি নির্ধারণ করে।অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর এক বিশেষজ্ঞ ড. ফ্রাংকসের মতে, ক্রোমোজোম ২-এর মধ্যে থাকা এলআরআরটিএম-১ জিনের জন্যে মানুষ হাত ব্যবহারে আলাদা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়। এছাড়াও মাতৃগর্ভে থাকাকালীন ডাই ইথাইল স্টিলবোস্টেরলের সংস্পর্শও শিশুকে বাঁ-হাতি হতে সাহায্য করে। নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের মধ্যে বাঁ-হাতি হওয়ার প্রবণতা অধিক দেখা যায়। শিশুর মা-বাবা দুজনই বাঁ-হাতি হলে, সেই সব সন্তানদের মধ্যে শতকরা ২৬ জনের বাঁ-হাতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বাঁ-হাতিদের নিয়ে কিছু বিশেষ তথ্য:
বাঁ-হাতিদের বাম হাত ব্যবহার করার অভ্যাসকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় সিনিস্ট্রালিটি বলা হয়। বলা হয়, বাঁ-হাতিরা ডানহাতিদের থেকে অনেক বেশি সৃজনশীল এবং বুদ্ধিমান হন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মস্তিষ্কের ডান এবং বাম অংশের মধ্যে সংযোগ, ডান-হাতিদের তুলনায় বাঁ-হাতিদের অনেক বেশি থাকে, যার ফলেই তাঁরা বেশি বুদ্ধিমান হন।

বাঁ-হাতিদের জলের তলায় দৃষ্টিশক্তি ডান-হাতিদের তুলনায় বেশি।

বিশ্ব বিখ্যাত মানুষদের মধ্যে অনেকেই বাঁ-হাতি। তালিকাটি নেহাত কম নয়, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, অ্যারিস্টটল, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মেরি কুরি, বারাক ওবামা, বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ, অমিতাভ বচ্চন, সচিন তেন্ডুলকর, ব্রায়ান লারা, ওয়াসিম আক্রাম, রাফায়েল নাদাল, ডেভিড গাওয়ার, এঞ্জেলিনা জোলি, টম ক্রুজ, হেলেন কেলার, লেডি গাগা, লুই ক্যারল, প্রিন্স উইলিয়াম, ওপরাহ উইনফ্রে এবং আরো অনেকে। বিশ্ববরেণ্য এই ব্যক্তিরা সকলেই বাঁ-হাতি।মার্কিন মুলুকের চার রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন বাঁ-হাতি। ক্রীড়া জগতে ক্রিকেট, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, টেনিস, বেসবল ইত্যাদি দলগত খেলায় বাঁ-হাতিরা বিশেষ সুবিধা পান। বাঁ-হাতি বোলারকে খেলা বা বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানকে বল করা অনেক বেশি সমস্যার।

স্বাভাবিক ভাবেই বিশ্বে বেশির ভাগ যন্ত্র এবং সরঞ্জাম ডানহাতিদের উপযোগী করে বানানো হয়। এ জন্য প্রতিবছর বিশ্বে দুই হাজারের বেশি বাঁ-হাতি মানুষ বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হন। বর্তমানে ধীরে ধীরে বাম হাতেও চালানো যায় এমন গ্যাজেট, যন্ত্র এবং সরঞ্জামগুলি তৈরি হচ্ছে এবং তাদের ব্যবহারও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাদ্যযন্ত্র, ক্রীড়া সরঞ্জাম এবং কাঁচি, ক্যান ওপেনারের মতো সামগ্রী বাঁ-হাতিদের ব্যবহারের মতো করেই এখন বানানো হয়। ডানহাতিদের তুলনায় বাঁ-হাতিদের অ্যালার্জিক হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। মাইগ্রেন ও অনিদ্রার সমস্যায় বাঁ-হাতিরা বেশি ভোগেন।

কথায় বলে, লেফট ইজ অলওয়েজ রাইট। পরিহাস করে বলা হলেও, বাঁ-হাতিরাও যে স্বাভাবিক মানুষ এবং ডান-হাতিদের তুলনায় খানিকটা হলেও এগিয়ে তাই এ কথা বলা।

ভালো থাকুন এ পৃথিবীর সব বাঁ-হাতিরা। এভাবেই গর্বিত করুন আমাদের।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...