তোয়ালে মোড়া আনন্দের পুঁটুলি। আদর মাখানো। জমানো ইচ্ছের ভাঁড়ার। এমন করেই পৃথিবীতে আসে ওরা। সারা জীবন জুড়ে দাগ কাটতে থাকে আরো অনেকগুলো মানুষের জীবনে। তারপর জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে একটি শিশুর পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠা সাহিত্যের মতই ঘটনাবহুল। তাতে কখনো থাকে সাফল্যের গন্ধ, কখনো আবার ব্যর্থতার গ্লানি তার জীবনকে বিদ্ধ করে। তবুও এগিয়ে চলে। পাওয়া, না পাওয়া সবকিছু মিলিয়ে মানুষের জীবনে পূর্ণতা আসে। কিন্তু এই তালিকায় যদি যুক্ত হয় লিঙ্গ বৈষম্য বা পক্ষপাতের মত সমস্যা, তখনই জীবনপথে ঘিরে ধরে রুক্ষতা। সেই রুক্ষতা ক্ষত-বিক্ষত করে তোলে মনকে। বাধা দেয় সুস্থ ভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে। কন্যাসন্তান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব বাধার সম্মুখীন হয় মেয়েরা। ফলে, নারী-পুরুষের সমানাধিকার ইউটোপিয়া হয়েই রয়ে যায়। সাম্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা আর লড়াই এই দুই মিলিয়েই কাটতে থাকে মেয়েদের জীবন। আধুনিক ধ্যান-ধারণা আমাদের মনকে স্বচ্ছ করবে এটাই প্রত্যাশা। এমন প্রত্যাশা, স্বপ্ন বুকে নিয়ে পৃথিবীতে বড় হয় মেয়েরা। কিন্তু সমাজ সেই ভাবনায় আঘাত হেনে নষ্ট করে তাদের স্বাভাবিক বিকাশকে। তাদের অবুঝ মন বোঝেনা তফাৎ একটা বয়স পর্যন্ত। মেয়েদের কোমল মনে স্বপ্নেরা চারা গাছের মতোই লালিত হয়। সেই গাছে হৃদ্যতাপূর্ণ জল, সার না দিয়ে তার বৃদ্ধিকে নষ্ট করে দেয়া হয় অনেক ক্ষেত্রেই। আন্তর্জাতিক কন্যা সন্তান দিবস সেইসব চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে যা একটি মেয়েকে তাঁর জীবনের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে। তাদের সংগ্রামসর্বস্ব জীবন থেকে মুক্তি দেওয়া ও সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পালিত হয় আন্তর্জাতিক কন্যাসন্তান দিবস। প্রতিবছর ১১ই অক্টোবর দিনটি পালিত হয়।
আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগের কথা। ২০০টি দেশ থেকে প্রায় ৩০,০০০ জন মহিলা এসেছিলেন চীনের বেইজিং প্রদেশে একটি সম্মেলনে যোগদান করতে। সম্মেলনের বিষয় ছিল চতুর্থ বিশ্বে মেয়েদের অবস্থার পরিবর্তন। এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্য ছিল সর্বস্তরের মহিলাদের সব রকম অধিকার স্থাপন করে সুস্থ সমাজব্যবস্থার গোড়াপত্তন। সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল যে বিষয়টিতে সেটি হলো লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা এই তিনটি ক্ষেত্রে মহিলারা যাতে কোনভাবেই কোনরকম লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার না হন তার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা। বলা ভালো সেদিনের সেই সম্মেলন ছিল নারী মুক্তি আন্দোলনের রূপান্তর। এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিল ইউনিসেফ। প্রতিবছর ১১ই অক্টোবের দিনটিতে আন্তর্জাতিক কন্যা দিবস পালন করা হবে সারা বিশ্বজুড়ে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেদিন। সেদিন সম্মেলনে যোগদান করা সেই সমস্ত মহিলারা তাঁদের দেশে আজও এগিয়ে নিয়ে চলেছেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সাম্যের এই ধারণাকে। যে কোনো বয়সেই মেয়েদের জীবনে 'বিভেদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ' এমন ধারণাকে পাথেয় করেই পালিত হয় এই দিনটি। তবে এই বছর ভার্চুয়ালি পালিত হবে এই দিন। নানা আলোচনা সভার আয়োজন করে ইউনিসেফ। এবছর এইসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে অনলাইন।
২০২০ সালের আন্তর্জাতিক কন্যা সন্তান দিবসের থিম "মাই ভয়েস, আওয়ার ইকুয়াল ফিউচার"। সারা বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে এই দিনে আয়োজিত কর্মশালায়। প্রত্যেক দেশ থেকে সমাজকর্মীরা আসেন। পৃথিবীর প্রান্তিক অঞ্চলগুলিতেও সাম্যের ধারণা পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়। এমন লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধিরা। ভারতে জাতীয় কন্যা সন্তান দিবস পালন করা হয় ২৪শে জানুয়ারি। তবে তা শুরু হয়েছে ২০০৮ থেকে। আমাদের দেশ মাতৃ রূপে পূজিত হয়। অর্থের দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে তুলনা করা হয় কন্যাসন্তানদের। তবে এসব নেহাতই অংশবিশেষ। সমাজের বড় একটা অংশে মেয়েরা এখনো লড়াই করছে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে। লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয়ে জীবনে চলার পথে কখনো মুখ থুবড়ে পড়ছেন। আধুনিক চিন্তাভাবনায় আমরা এগোলেও তা এখনো পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েনি। বিষয়টা শুনতে হয়তো ক্লিশে। কিন্তু ব্যতিক্রমীদের সংখ্যা এতটাই কম যে, ক্লিশেরা আজও বহাল তবিয়তে টিকে রয়েছে। মেয়েদের জীবনের মলিনতা মুক্তির প্রচেষ্টাকে সম্মান জন্যই কন্যাসন্তান দিবসের মূল লক্ষ্য। মেয়েরা প্রকৃত অর্থেই সমাজ ব্যবস্থার কাঠামো। তাঁরা শুধুমাত্র বেঁচে না থেকে সব রকম বিভেদের ঊর্ধ্বে গিয়ে জীবনের স্বাদ নিক এটাই কাম্য।