আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস উপলক্ষে দু-চারটে কথা

এই দৃশ্যটা বলে বোধহয় সব মানুষের স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে… সপ্তাহের যে কোনো একটি দিন। সেটা রবিবার বা কোনো ছুটির দিন নয়, কোনো কর্মদিবস। সকাল সাতটা কি সাড়ে সাতটা। সাড়ে দশটায় স্কুল যেতে হবে। সকালে উঠে দু ঘন্টা পড়াশুনা করতে হবে। মা এসে ওঠার জন্য তাড়া দিচ্ছে। না উঠলে দুই ধমক।

আধো আধো ঘুমের মধ্যে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে ঠাকুরমা মা’কে বলছেন “সকাল সকাল অত বকাঝকা করো কেন বৌমা? সরো দেখি”... বলে আদর করে গায়ে হাত বুলিয়ে বলছেন "উঠে পড়ো দিদিভাই/দাদাভাই, লক্ষ্মী সোনা। বেলা হয়ে গেছে সোনাদিদি/ দাদা আমার"... ঘুম ঘুম চোখে উঠতে উঠতে ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরা। আর ঠাকুমার গায়ের থেকে ভেসে আসে একটা আশ্চর্য মিষ্টি গন্ধ.... ফুল, ধূপধুনো, চন্দন, সুগন্ধি তেল, রান্নার হলুদ-জিরে-পাঁচফোড়ন মেশানো সেই অদ্ভুত সুন্দর গন্ধটা শুধু ঠাকুরমা আর মা’র গায়েই পাওয়া যায়।

তারপরেই স্বপ্নটা শুরু হয় এইখান থেকে... ঠাকুরদা বা বাবার হাত ধরে স্কুলে বা কোন কোন ছুটির দিন বাজারে চলেছে সে... লাফাতে লাফাতে... হাজার রকমের প্রশ্ন তার। ঠাকুরদা তার সাধ্য মতো উত্তর দিচ্ছেন। রাস্তায় চলার পথে পাঁচজন পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা.. তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত কথা বলা... বাজারের সব্জি বা মাছ বিক্রেতাদেরও ভাল মন্দ সুখ দুঃখের খোঁজ খবর নেওয়া। ফেরার পথে একটা মিষ্টি বা একটা চকলেট; হয়তো সেটা ঠাকুরদা কিনে দিচ্ছেন, হয়ত বা দোকানদার কাকু আদর করে এমনিই দিচ্ছেন।

পাঠকবন্ধু, একবারটি ভেবে দেখুন এই স্বপ্নগুলো কি ঘুরে ফিরে আমরা প্রত্যেকে দেখি না? স্মৃতিতে বারবার ফিরে আসে না কি মামাবাড়িতে গরমের ছুটি বা পুজোর ছুটিতে গিয়ে তুমুল আনন্দে কাটানো দিনগুলোর কথা?

এই যে আমাদের নিজেদের ঘর, মামার বাড়ি, পিসি মাসির বাড়ি অথবা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী... এই সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটা চার অক্ষরের শব্দ... পরিবার। ছোট থেকেই তো আমরা পড়ি বা শিখি যে মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। আর এই সমাজে বদ্ধ হওয়ার শুরুটা কিন্তু হয় আমাদের পরিবার থেকে।

তাই পরিবারের গুরুত্ব আমাদের জীবনে অপরিসীম। পরিবার থেকেই আমরা একে অপরকে ভালবাসতে শিখি। অন্যের সুখে, দুঃখে, বিপদে, আপদে, আনন্দে বেদনায় তার পাশে দাঁড়াতে শিখি। এই যে নিঃস্বার্থভাবে অন্যের উপকার করা, অন্যের সুখে নিজে সুখী হওয়া... এই শিক্ষা বা বোধও কিন্তু আমাদের পরিবার থেকেই পাওয়া।

শুধু কি বাবা মা ভাই বোন নিয়েই একটি পরিবার? হয়ত আক্ষরিক অর্থে তাইই। কিন্তু বৃহত্তর অর্থে আমাদের বাড়ির যে আশ্রিত কুকুরটি বিড়ালটি, পাড়া প্রতিবেশী, নিজের এলাকা, শহর, জেলা, রাজ্য এমনকি আমার দেশটাও কি আমারই পরিবার নয়? এই যে আমরা আমাদের দেশের যে কোনো কৃতিত্বের জন্য গর্বিত হই সে ও এই কারণেই যে প্রতিটি ভারতবাসীকেই আমরা নিজের ঘরের মানুষ বলে ভাবি।

সত্যি কথা বলতে আমাদের বাড়িতে বাগানে যে গাছগুলো আছে, তাদের ফুল, ফল, পাখি, প্রজাপতি নিয়ে তারাও আমাদের পরিবারের সদস্য ছাড়া আর কী? অর্থাৎ আমাদের ছোট্ট পরিবারই কিন্তু আমাদের অনেক বড় ভাবে ভাবতে শেখায়, বড় কোন কাজে উদ্বুদ্ধ করে। তাই পরিবারকে বাদ দিয়ে একক ভাবে আমরা কখনই সম্পূর্ণ নই। ভালবাসার ধারণা বা কনসেপ্টটাই আসে আমাদের পরিবার থেকে।

এই প্রসঙ্গে দুটি-- না না তিনটি বিখ্যাত চলচ্চিত্রের নাম উল্লেখ করি? প্রথমটি হল পৃথিবী বিখ্যাত ছবি "সাউন্ড অফ মিউজিক"... যেটা অনুসরণে তৈরি হয়েছিল বাংলা ছবি "জয়জয়ন্তী"। এবং তপন সিংহ পরিচালিত কালজয়ী ছবি "গল্প হলেও সত্যি"। এই সবকটি ছবিতে দেখান হয়েছিল যে মূল্যবোধ নিয়ে আমরা বড় হই সেই নিঃস্বার্থ ভালবাসার আঁতুরঘর আমাদের পরিবারই।

আর এই যে মানুষের জীবনে পরিবারের গুরুত্ব... এটা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যই কিন্তু "আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস" এর প্রবর্তন করা হয়েছে। প্রত্যেক বছর ১৫ মে এই আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস পালন করা হয় এটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই যে পরিবারের সবাই যদি স্বার্থহীন ভাবে একে অপরকে ভালবাসি, শুধুমাত্র নিজের সুখের কথা না ভেবে যেন একে অপরের পাশে দাঁড়াই তাহলেই আমরা সুন্দর সমাজ, সুন্দর জাতি, সুন্দর দেশ গঠন করতে পারব।

আজ এই ভয়ঙ্কর মহামারীর সময় তো আমরা আরও ভালভাবে বুঝতে পারছি পরিবারের গুরুত্ব কতখানি। আসুন, আমরা সবাই সবার পাশে থেকে এই পাজি অসুখকে হারিয়ে দিই।

সকলকে পরিবার দিবসের শুভেচ্ছা জানাই। সবাই সপরিবারে সুস্থ থাকুন ভাল থাকুন। এই লেখা শেষ করি সদ্য প্রয়াত জ্ঞানপীঠ প্রাপ্ত কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে....

আমাদের ডান পাশে ধ্বস
আমাদের বাঁয়ে গিরিখাদ
আমাদের মাথায় বোমারু
পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ
আমাদের পথ নেই কোনো
আমাদের ঘর গেছে উড়ে
আমাদের শিশুদের শব
ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে!
আমরাও তবে এইভাবে
এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি?
আমাদের পথ নেই আর
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।

("আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি"- শঙ্খ ঘোষ)

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...