আন্তর্জাতিক সুখ দিবস

মান্না দের গাওয়া একটি অতি জনপ্রিয় গান আমাদের মুখে মুখে ফেরে–
"সবাই তো সুখী হতে চায় তবু কেউ সুখী হয় কেউ হয় না।
জানি না বলে যা লোকে সত্যি কিনা কপালে সবার নাকি সুখ সয় না "-

সত্যিই কি তাই? সুখী হওয়া কি এতই কঠিন? সেই কতদিন আগে মহাভারতে অজ্ঞাতবাস চলাকালীন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির বকরূপী যক্ষের প্রশ্ন "প্রকৃত সুখী কে?" এর উত্তরে বলেছিলেন "যাহার ঋণ নাই, আর নিজের ঘরে থাকিয়া দিনের শেষে যে চারিটি শাক-ভাত খাইতে পায়, সেই সুখী।"

কিন্তু তাহলে মানুষ সুখ নামের সোনার হরিণটিকে ধরার জন্য ছুটে বেড়ায় কেন? বৈষ্ণব পদাবলীতে শ্রীরাধিকা বিলাপ করে বলেছিলেন

"সুখের লাগিয়া এ ঘর বান্ধিনু অনলে পুড়িয়া গেল
অমিয় সাগরে সিনান করিনু সকলি গরল ভেল"

 

Happiness1

 

অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণই হলেন তাঁর সর্ব সুখের উৎস। অমৃত সুধায় অবগাহন করলেও তা বিষ বলে মনে হয় কৃষ্ণ বিনা।

তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে "সুখ" ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে। কেউ এমনি এমনি পায় আবার কেউ বিশাল ধনী হয়েও সারাজীবন সুখের সন্ধানে ছুটে বেড়ায়। এই আপাত-চঞ্চল বস্তুটি- না, না, সুখ কি আর দেখতে পাওয়া যায় যে এটি একটি বস্তু হবে? এই অ্যাবস্ট্রাক্ট নাউনটি যাইই হোক না কেন, সুখ নামের শুকপাখিটির জন্য সব মানুষ যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করে আসছেন। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে এই পৃথিবীর সব মানুষ যেন সুখী হতে পারে, সুখী হওয়ার উপায় খুঁজে পায়, সুখে থাকার ন্যূনতম সুযোগটুকু পায় সেইজন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘ একটি বিশেষ দিনকে "আন্তর্জাতিক সুখ দিবস" হিসেবে ঘোষণা করেছে। দিনটি হলো ২০মার্চ। এবার এই দিনটির ইতিহাস এবং তাৎপর্য একটু তুলে ধরা যাক।

আন্তর্জাতিক সুখ দিবস প্রচলনের প্রচারটি শুরু করেছিল মূলত আমাদের প্রতিবেশী ছোট্ট কিন্তু সুখী দেশ ভুটান। ভুটানে সুখ-সূচকের ভিত্তিতে জাতীয় সমৃদ্ধির পরিমাপের প্রচলন হয়েছে। তারা জাতিসংঘের কাছে বছরের একটি দিন সুখ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানায়। এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ‘আন্তর্জাতিক সুখ দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

মানুষ সুখ প্রত্যাশী। সবাই সুখী হতে চায়। পৃথিবীতে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যে সুখী হতে চায় না। প্রত্যেকটি মানুষের জীবনের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু সুখে থাকা। আর এই সুখে থাকার জন্য মূলতঃ যে বিষয়গুলি সবথেকে জরুরি সেগুলো হলো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য (সেটা শারীরিক এবং মানসিক দুইই) এবং সুন্দর দূষণহীন পৃথিবী। এই তিনটি বিষয় যাতে সুষ্ঠুভাবে প্রতিটি মানুষের জীবনে সুনিশ্চিত করা যেতে পারে তার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা ও প্রচার চালিয়ে যাওয়া – এই উদ্দেশ্য নিয়েই অর্থজাতিসংঘের উপদেষ্টা এবং শান্তি ও নিরাপত্তা অর্থনীতিবিদদের প্রতিনিধি জেম এলিয়েন দিবসটির প্রতিষ্ঠা করেন।

 

Happiness2

 

২০১২ সালের ২৮ জুন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ২০ মার্চ–এই দিনটি "আন্তর্জাতিক সুখ দিবস" রূপে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেই অধিবেশনে জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশের প্রতিনিধিরা দিনটিকে "আন্তর্জাতিক সুখ দিবস" হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এই বিশেষ দিবসটি পালন সংক্রান্ত বিষয়ে ইউনাইটেড নেশনস অর্গ্যানাইজেশন বা জাতি সংঘের সাধারণ অধিবেশনের প্রস্তাবে বলা হয়, সুখের অনুসন্ধান একটি মৌলিক মানবিক লক্ষ্য। সবার অধিকার আছে সুখী হওয়ার। ২০১৩ সাল থেকে, জাতিসংঘ সারা বিশ্বের মানুষের জীবনে সুখের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার উপায় হিসাবে আন্তর্জাতিক সুখ দিবস উদযাপন করে চলেছে। ২০১৫ সালে, জাতিসংঘ দারিদ্র্যের অবসান ঘটিয়ে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য হ্রাস এবং আমাদের গ্রহকে রক্ষা করার ১৭টি উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা চালু করেছে, যাতে এই পৃথিবীর সমস্ত মানুষের মঙ্গল হয় ও সুখে থাকার দিকে এগিয়ে যায়।

জাতিসংঘ যেকোনো বয়সের, যে কোনো শ্রেণীর প্রতিটি মানুষ এবং দেশের সরকারকে আন্তর্জাতিক সুখ দিবস উদযাপনে যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছিল। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মাধ্যমে এবং দারিদ্র্য বিমোচন করে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই দিবসটি পালন করা হবে বলে ঠিক করা হয়। জাতিসংঘের সদস্য সমস্ত রাষ্ট্রকে শিক্ষা ও জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডসহ যথাযথ রীতিতে আন্তর্জাতিক সুখ দিবস পালনের আহ্বান জানানো হয়েছিল। এরপর থেকে প্রতিবছর বিশ্বের নানা দেশেই দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালন হয়।

আজকের এই সময়ে আমাদের প্রিয় পৃথিবী এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে চলছে, যখন সারা পৃথিবীর মানুষ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ভয়ঙ্কর এক ভাইরাসের আক্রমনে সারা বিশ্ব বিপর্যস্ত। থেকে মুক্তির পথ কী? সেই কারণে এই বছরের সুখ দিবসের থিম 'Build Back Happier', যা কিনা এই কোভিড মহামারী থেকে পৃথিবীকে পুনরুদ্ধারের দিকে মনোনিবেশ করবে। আর সেইজন্য এইসময় সবথেকে বেশি প্রয়োজন মানুষের পাশে থাকা। এতক্ষণ তো সুখ কী আর সুখ দিবসের তাৎপর্য কী তা নিয়ে অনেক কথা হলো। কিন্তু এ কথা কি সত্যি নয় যে মানুষের পাশে থেকে মানুষের দুঃখ দূর করার উদ্যোগে যে সুখ যে আনন্দ পাওয়া যায় তা আর কোনো কিছুতেই নেই? বিখ্যাত কবি কামিনী রায় রচিত একটি কবিতার অংশবিশেষ দিয়ে এই নিবন্ধ শেষ করা যাক।

"নাই কি রে সুখ ? নাই কি রে সুখ ?
এ ধরা কি শুধু বিষাদময় ?
যাতনে জ্বালিয়া, কাঁদিয়া মরিতে
কেবলই কি নর জনম লয় ?

পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি,
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে ?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।"....

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...