এক আলোর নাম-সুনীতা কৃষ্ণন

১৫ বছর বয়স এক কিশোরীর। ছোটবেলা থেকেই সে সাহসী। ‌বুদ্ধিমতী। চিন্তাশীল ও ধৈর্যশীল। অবহেলিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের কষ্ট তাকে আঘাত দেয়। মেয়েটার সবচেয়ে বড় সঙ্গী ছিল তাঁর বাবা।

মেয়েটা উচ্চতায় সাড়ে চার ফুট। সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। কিন্তু মনোবল যুগিয়েছিল বাবা। “তোমার শারীরিক উচ্চতা যাই হোক না কেন, তা নিয়ে কখনও লজ্জা পাবে না। ‌মনের দিক থেকে বড় হওয়ার চেষ্টা করো।” বাবার বলা এই কথাগুলো মনের ভেতরে একেবারে গেঁথে নিয়েছিল সুনীতা। সহজ কথায় বললে এই বলা কথার বিশ্বাসেই ছোট থেকেই নিজের লক্ষ্যে অবিচল ছিল সুনীতা কৃষ্ণন।

১২ বছর বয়স। সুনীতা তখন কিশোরী। জন্ম বেঙ্গালুরুতে। যে স্কুলে পড়ত তার ঠিক পাশেই ছিল একটা বস্তি। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল সুনীতা। বস্তির বাচ্চাগুলোর কাঁধে ওই সময় কোন স্কুল-ব্যাগ ছিল না। সুনীতা বুঝেছিল ভাগ্যের ফেরে শিক্ষা পাওয়ার ক্ষমতা বা পরিস্থিতি ওদের নেই। নিজের কর্তব্য তখনই ঠিক করে ফেলে ও।

স্কুল শেষে প্রতিদিন বস্তির বাচ্চাদের পড়াতে যেত সুনীতা। শুধু পড়াশোনা কেন, পড়াশোনা ছাড়াও আরও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কাজকর্ম সেই বস্তির বাচ্চাদের শেখানোর ব্যাপারে উদ্যোগ নিল সুনীতা। এদিকে অনেকেই এক কিশোরীর এই সমাজ বদলের চেষ্টাকে অহেতুক বাড়াবাড়ি মনে করতে লাগলেন। বারণ করা হল সুনীতাকে।

কিন্তু এই মেয়ের মনের শক্তি লোহার মতোই দৃঢ়। ভয় না পেয়ে দ্বিগুণ উদ্যোগে কাজ শুরু করল সুনীতা। সুনীতার এই 'দুঃসাহসের' পরিণাম ছিল ভয়ংকর। পনেরো বছর বয়সে ধর্ষিতা হয়েছিল সুনীতা। যন্ত্রণা, কষ্ট সুনীতাকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময় অর্থহীন মনে হয়েছিল জীবন। তবে বাবা পাশে থেকে সঙ্গ দিচ্ছিল। পরিবারের অন্যান্য মানুষরাও সাধ্যমত সমর্থন যুগিয়েছে। কিন্তু লোক-লজ্জা বড় বালাই। তাই ভয়ে কখনো গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেদের।

শুরুর দিকে মেয়েকে সাহস জোগাতেন তাঁরা। সুনীতাও তখন যন্ত্রণাক্লিষ্ট। কিন্তু ধীরে ধীরে নিজের অন্তরের শক্তির সাধনা করতে শুরু করেন সুনীতা। এদিকে বাবা-মা মুখ ফেরাচ্ছেন ধীরে ধীরে। তাঁরা চাইছিলেন মেয়ে ঘরেই থাকুক। কিন্তু মেয়ে নাছোড়বান্দা। তিনি চাইছেন অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করতে। নিজের মতাদর্শে অবিচল ছিলেন সুনীতা।

আবার নিও-লিট্যারেসি ক্যাম্পেইন শুরু করেন সুনীতা। বস্তির শিশুদের আবার পড়ানো শুরু করেন। তিনি বলেছেন “ধর্ষণের মত ঘটনা শুরুতে আমায় দুর্বল করে দিলেও, ভাঙতে পারেনি। বরং আরও মানসিক শক্তি যুগিয়েছিল। আমার ভেতরে একটা রাগ তৈরী হয়েছিল যা আজও রয়েছে। তাই আমার এনজিও-র নাম রেখেছি 'প্রজ্জ্বলা'। এই রাগ বেঁচে থাকুক, এটাই আমি চাই, আর এটাই আমায় কাজের শক্তি জোগাবে।"

স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে সুনীতা সোশ্যালওয়ার্ক নিয়ে পড়াশোনা করা শুরু করেন। এরপরই শুরু হয় তাঁর আসল লড়াই। নব্বই দশকের শেষ দিকে সুনীতা পুরোপুরি সামাজিক কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। বেঙ্গালুরু থেকে হায়দ্রাবাদ চলে আসেন। ওখানে নারীপাচারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন তিনি। হায়দ্রাবাদের রেড লাইট অঞ্চলে প্রথম কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। যৌন শ্রমিক হিসেবে পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। সুনীতার সংস্থা এখনও পর্যন্ত প্রায় ১২০০০-এরও বেশি মেয়েদের পাচার হয়ে যাওয়া থেকে আটকেছেন।

শুরুর দিকে সুনীতা নিজের সংস্থা প্রজ্জ্বলা চালাতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছেন। নিজের গয়না বিক্রি করে শুরু করেছিলেন এই সংস্থা। সব জমানো টাকা দিয়ে দিতে হয়েছিল এই সংস্থা চালাতে। তারপর ধীরে ধীরে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করেছিলেন সুনীতা। সঙ্গে পেয়েছিলেন অনেক লড়াকু নারীকে। সুনীতা কৃষ্ণন-এর এই সংস্থা আজও কাজ করে চলেছে নারী পাচারের বিরুদ্ধে। নারী পাচারের মত অসুখ সমাজকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। এই অন্ধকারে সুনীতারা আলো দেখান। ধ্রুবতারার মত শাশ্বত তাঁর লড়াই।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...