বেড়াতে যারা ভালবাসে তাদের কাছে আন্দামান স্বপ্নের ডেস্টিনেশন। নীল সমুদ্র, সাদা বালী, রহস্যময় দ্বীপবাসী মানুষের রূপকথা। সঙ্গে মিশে আছে ইতিহাসের কাহিনি। এই সব মিলিয়েই আন্দামান। দেশি আর বিদেশি দু’ধরনের পর্যটকদেরই সমানভাবে টানে।
‘আন্দামান’ এই শব্দ দুটি এসেছে মালয় ভাষা থেকে। মালয় ভাষায় আন্দামান ‘হান্দামান’। ‘নাক্কাভারম’ থেকে ‘নিকোবর’। নিকোবর শব্দের অর্থ নগ্ন মানুষের বাস।
আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাসকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। ব্রিটিশ অধিকার প্রতিষ্ঠা, ব্রিটিশ রাজত্ব, জাপানি রাজত্ব ও স্বাধীনোত্তর যুগের ইতিহাস।
১৭৮৮ সালে দুই নৌ-আধিকারিকের সুপারিশক্রমে ১৭৮৯ সালে তদনীন্তন গভর্নর-জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশ পোর্ট কর্নওয়ালিশের কাছে চাটহাম দ্বীপে একটি ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপন করেন। এই বছরই লেফটানেন্ট রেজিনল্ড ব্লেয়ার এই অঞ্চলে একটি সমীক্ষার কাজ চালান। তার নামানুসারে পোর্ট কর্নওয়ালিশের নাম হয় পোর্ট ব্লেয়ার।
আন্দামানকে বলা হত ‘কালাপানির দেশ’। পরাধীন দেশে বিপ্লবীদের ওপর নেমে আসত কালাপানির সাজা। সেলুলার জেল ব্রিটিশের নির্মম অত্যাচারের সাক্ষী। দেশের মূলভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দ্বীপ নির্বাসন। অনেক সময়ই আর ফেরার পথ থাকত না। নৃশংস অত্যাচারে বিপ্লবীদের জীবন শেষ হয়ে যেত কারাগারেই। আন্দামানের সেলুলার থেকে যাঁরা ফিরতেন তাঁরা আর কোনওভাবেই পূর্বাবস্থায় ফিরতে পারতেন না। ক্ষয়ে যেত শরীর।
১৮৫৭ সালে সংঘটিত সিপাহী বিদ্রোহের সময় থেকেই আন্দামান দ্বীপপুঞ্জকে বন্দীশিবির হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল ব্রিটিশরা। তখনও কারাগার নির্মাণ করা হয়নি। কারারক্ষী ডেভিড ব্যারি এবং সামরিক চিকিৎসক মেজর জেমস প্যাটিসন ওয়াকারের তত্ত্বাবধায়নে সিপাহী বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী শতাধিক বিদ্রোহীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আন্দামানে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চলাকালে ১৯৪২ সালের ২১ মার্চ আন্দামান দখল করে নেয় জাপান। জাপানি সেনাবাহিনীর হাতে এই অঞ্চলের বহু নিরপরাধ মানুষও নিহত হন। পরে জাপানিরা এই দ্বীপপুঞ্জ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে তুলে দেয়।
১৯৪৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর সুভাষচন্দ্র পোর্ট ব্লেয়ারে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চল ব্রিটিশদের অধিকারমুক্ত ছিল। এই সময় আন্দামান খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়ে ওঠে। ১৯৪৫ সালের ৮ অক্টোবর জাপানি সেনাবাহিনীর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া কম্যান্ড পোর্ট ব্লেয়ারে আত্মসমর্পণ করলে ব্রিটিশরা এই দ্বীপপুঞ্জের অধিকার আবার ফিরে পায়।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর আন্দামান ও নিকবর দ্বীপপুঞ্জ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রকৃতপক্ষে কতজন ভারতীয়কে এই দ্বীপপুঞ্জে আনা হয়েছিল তার সঠিক হিসাব নিরুপন করা মুসকিল,কারণ বহু তথ্য ব্রিটিশরা নষ্ট করে দেয়। তবে অনুমান করা হয় প্রায় আশি হাজার।
এখন আন্দামান জনপ্রিয় টুরিস্ট ডেস্টিনেশন। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সারা পৃথিবীর পর্যটক মানচিত্রে এই দ্বীপপুঞ্জকে চিহ্নিত করেছে ‘ড্রিম ডেস্টিনেশন’ হিসেবে। রাধারনগর সৈকত, হ্যাবলক- এশিয়ার অন্যতম সেরা সমুদ্র সৈকত হিসেবে পুরস্কৃত।
বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত ৫৭২টি ছোট-বড় দ্বীপ নিয়ে গঠিত হয়েছে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার। এই আইল্যান্ডের এক মাত্র আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরটি পোর্ট ব্লেয়ারেই অবস্থিত।
আন্দামান নিকোবরের অন্যতম প্রধান ভাষা বাংলা। এই দ্বীপপুঞ্জে প্রচুর বাঙালির বাস। দ্বিতীয় প্রধান ভাষা হিন্দি। এছাড়াও মালায়ালাম, তামিল, তেলেগুর মতো দক্ষিণী ভাষাও চলে।
চারপাশে পাহাড় আর মাঝখানে জলে ঘেরা দ্বীপ এশিয়ার অন্যতম সেরা সমুদ্র সৈকত। চলে নানারকম ওয়াটার গেমস। নিকোবরের কাছেই আছে ছোট্ট দ্বীপ কাটচাল। এই দ্বীপ শতাব্দীর প্রথম সূর্যোদয় দেখেছিল।
আন্দামানের হকসবিল, গ্রিন টার্টেল ও বিশ্বের বৃহত্তম কচ্ছপ লেদারব্যাক টার্টেল অন্যতম বিচরণভূমি এই দ্বীপ। গোটা পৃথিবীর জলচরপ্রাণী বিশারদদের কাছে এই দ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ। হারমিট কাঁকড়া বা বিরগাস ল্যাটরো বিশ্বের বৃহত্তম কাঁকড়া। যা শুধুমাত্র আন্দামানেই দেখা যায়। এগুলি বেশিরভাগই অর্থোপড অর্থাত্ সৈকতের বালিতেই দেখা যায়। এখানকার রাজ্যপশু ‘ডুগঙ্গ’। এদের ‘সামুদ্রিক গরু’ও বলা হয়। এরা খুবই শান্ত ও নিরামিষাশী। ‘ডুগঙ্গ’কে ‘সমুদ্রের পরী’ও বলা হয়।
এখানকার উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপে বিশ্বের বিচ্ছিন্নতম প্যালিওলিথিক উপজাতিরা থাকেন। বর্তমানে এঁদের সংখ্যা তিনশোর আশেপাশে। আন্দামানের ব্যারেন দ্বীপে এশিয়ার একমাত্র সক্রিয় আগ্নেয়গিরিটি রয়েছে। ১৭৮৭ সালে নিষ্ক্রিয় আগ্নেয়গিরিটি প্রথম অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল। শত বছর পর ২০১০ সালে ফের একবার অগ্ন্যুৎপাত হয়। আন্দামানের বারাটাঙ্গ ভারতের একমাত্র এলাকা যেখানে কাদার আগ্নেয়গিরি রয়েছে।
ভারতের দক্ষিণতম বিন্দু ‘ইন্দিরা পয়েন্ট’ও এখানেই অবস্থিত। ‘পান্ডুনাস’ নামে বিরলতম একটি ফল পাওয়া যায় নিকোবরে। স্থানীয় মানুষদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় খাদ্য। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মাছ ধরা নিষিদ্ধ আন্দামান ও নিকোবর অক্টোবর থেকে মে মাস এই দ্বীপপুঞ্জে বেড়াতে যাওয়ার সেরা সময়।