হাওড়ার রামরাজাতলার মেয়ে রাজশ্রী। মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া, তারপর কর্পোরেট চাকরির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নির্দিষ্ট সময়েই। তবে ভেতরে ভেতরে স্বাধীন কোনো একটা কাজ করার কথা মাথায় ছিল রাজশ্রীর। গতে বাঁধা চাকরি, মোটা টাকা মাইনে, এর বাইরেও জীবনে স্বাধীনভাবে নিজের মত করে রোজগার করার স্বপ্ন দেখতেন রাজশ্রী। এমন সময়েই রাজশ্রীর বিয়ে হয় হাওড়ার মাজুতে। স্বামী সংবিদ গোলুই আইআইটি দিল্লি থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার। একটি নামকরা সংস্থায় উচ্চপদে চাকরি করতেন তিনি। রাজশ্রী নিজেও যথেষ্ট ভালো উপার্জন করতেন।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তবে নিজেদের রোজগার করার ধরণ নিয়ে খুশি ছিলেন না। অনেক টাকা আয় করে নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যেভরা জীবনের স্বপ্ন রাজশ্রী গলুই এবং তার স্বামী সঙ্গীত গুলোই কখনই দেখেননি। বরং দুজনে চেয়েছিলেন স্বাধীনভাবে রোজগার করতে এবং অনেক দুঃস্থ বেকার মানুষের জীবনে রোজগারের পথ খুলে দিতে।
নিজের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে করা চাকরিটি অবলীলায় ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রাজশ্রীর স্বামী সংবিদ গোলুই। হাওড়ার মাজুর প্রখ্যাত স্কুল শিক্ষক ঋষিকেশ গোলুইয়ের ছোট ছেলে সংবিদ গোলুই। বাবা দীর্ঘদিন স্কুল শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত থেকে আদর্শের পথ থেকে কখনো সরেন নি। ছেলেও বাবার আদর্শে দীক্ষিত ছিল। সেই আদর্শ অনুপ্রাণিত করেছিল রাজশ্রীকেও। স্বামীর পাশে দাঁড়াতে এক কথায় নিজের মোটা মাইনের কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে দেন রাজশ্রী। স্বামীর সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন একটি সংস্থা। নিজেদের জমানো টাকায় স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে মাটির জিনিস তৈরির ব্যবসা শুরু করেন।
হাওড়ার মাজুর প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে সমস্ত কারিগররা হাতের কাজ জানা সত্ত্বেও সামান্য টাকা উপার্জনের জন্য শহরে বিভিন্ন প্রাইভেট সংস্থায় কাজে বেড়াতেন তাঁদের রীতিমতো ডেকে ডেকে কাজ করাতেন রাজশ্রী ও তাঁর স্বামী। শুধু তাই নয় নিজেদের সংস্থায় কর্মসংস্থানের সুযোগ দেন মেয়েদেরও। ওদের তৈরি করা সংস্থার একটা বিশেষ অংশে শুধু মেয়েরাই কাজ করেন। হাওড়ায় আগে জরির বিশেষ বাজার ছিল। এই সংক্রান্ত কাজ হত নিষ্ঠার সঙ্গে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক ব্যবসাই যেমনভাবে অবলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে, হাওড়ায় জরির ব্যবসাও সেই সময় অর্থাৎ ২০২০ সালে বেশ পড়তির দিকে ছিল। সেই সব মানুষদের একত্রিত করে নিজেদের সংস্থায় কাজ দিয়েছিলেন রাজশ্রী ও সংবিদ।
শুরুর দিকে লাভের মুখ সেভাবে দেখেনি ওদের সংস্থা। এমনকী নিজেদের জমানো পুঁজি থেকেই খরচ করতে হয়েছিল। তবে মাজু অঞ্চলের কারিগররা রাজশ্রী আর সংবিদের এই সংস্থাকে নিজেদের মাটির মত করে ভালবেসেছিল। লাভের আশায় নয় কোন কিছু গড়ে তোলার স্বপ্নকে সঙ্গে নিয়েই এই সংস্থা গড়ে ওঠে। এখানে যারা কাজ করেন তারা মাটিকে ভালোবাসেন, আর ভালোবাসেন রাজশ্রী আর ওর স্বামীকে। ওদের স্বাধীনভাবে রোজগার করার চিন্তা ভাবনা এবং অন্যকে স্বনির্ভর করে তোলার চিন্তা ভাবনাকে মাজু অঞ্চলের মানুষরা কুর্ণিশ জানান।
গ্রাম রাজ্য অতিক্রম করে ওদের কারিগরদের কাজের কথা এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। মাজুর গ্রামে বসে মাটির যেসব অভিনব জিনিস তৈরি হয় তা পৌঁছে যায় ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে। ওরা মাটির বিভিন্ন আলো তৈরি করেন। অর্থাৎ আলো ধরে রাখার আধার তৈরি করেন রাজশ্রীদের সংস্থা। ওই অঞ্চলে কর্মসংস্থানের একটা বড় সুযোগ করে দিয়েছে এই সংস্থা। এছাড়াও আধুনিক যুগে মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার এক উৎসাহব্যঞ্জক উদ্যোগ। স্বাধীনভাবে কাজ করার স্পৃহা, নিজের ভাবনা মত রোজগার করার উপায়কে সম্বল করেই এ যেন শিল্প বাঁচানোর লড়াই।