একলা মেয়ে পাল্টে দিয়েছিল দার্জিলিং-এর চুইখিম গ্রামের অর্থনৈতিক মানচিত্র

২০০৫ সাল। তখন শুধুই দার্জিলিং ছিল। কালিম্পং জেলার জন্ম হয়নি। দার্জিলিং-এর একেবারে প্রত্যন্ত একটা গ্রাম। চুইখিম। ছবির মতো একটা গ্রাম।

নিজের গ্রামকে বড় ভালোবাসত পবিত্রা খাওয়াস। কিন্তু এই গ্রামে কোন সুযোগ-সুবিধা ছিল না, পড়াশোনা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এমনকী রোজগারের ব্যবস্থাও সেভাবে গ্রামে ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতো সকলে। এই অবস্থা পাল্টানোর শপথ গ্রহণ করেছিল পবিত্রা। কিন্তু পথটা এত সহজ ছিল না।

দার্জিলিং-এর এই গ্রামটা পরিত্যক্ত অঞ্চলের মতই পড়ে থাকত, ট্যুরিস্ট এলেও তারা টুকটাক ছবি তুলে এক বেলার জন্য গ্রামে ঘুরে চলে যেত। কারণ কাঞ্চনজঙ্ঘা বা পাহাড়ি মায়াবী নদী কোনটাই ভান্ডারে ছিল না গ্রামের। তবে অপূর্ব মায়া মাখানো সৌন্দর্য রয়েছে এই গ্রামের। একবার কয়েকজন অতিথি বিপদে পড়ে এসে পড়েছিল ওই গ্রামে। গ্রামে মানুষজনের সংখ্যা খুব কম, আশ্রয়ের খোঁজে তারা যখন এই বাড়ি ওই বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে, সাহস দেখিয়েছিল পবিত্রা। অচেনা চারজন পুরুষকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয় সে। নিজের হাতে বাজার করে রান্না করে দেয়। তাদের বোঝায় যে এই গ্রামটা অপূর্ব সুন্দর, ট্যুরিস্টরা যাতায়াত শুরু করলে এই গ্রামে সব দিক থেকে উন্নয়ন ঘটবে। এই রাতের জন্য কম কথা শুনতে হয়নি পবিত্রাকে। একলা মেয়ে চারজন পুরুষকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে, দার্জিলিং-এর ওই গ্রামে এমন কথা কেউ ভাবতেই পারতো না। কিন্তু পবিত্রা তাদেরকেও বুঝিয়েছিল এই গ্রামের উন্নয়নের জন্য ট্যুরিস্টদের যাওয়া আসা কতটা জরুরি।

বেশিরভাগ গ্রামবাসী বাইরে চলে যেত এই গ্রাম থেকে, যারা থাকত টুকটাক ব্যবসা করে দিন কাটাত। মেয়েরাও কাজের খোঁজে চুইখিম ছেড়ে চলে যেত। মূলত চাষাবাদ করেই এই গ্রামের কয়েক ঘর পরিবার নিজেদের দিন কাটাত।

ছয় ভাইয়ের একমাত্র বোন পবিত্রা। মা-বাবার মৃত্যুর পর দাদারা সকলেই আলাদা হয়ে যায়। তখন থেকেই একটা অন্যরকম কোন কাজ করার নেশা পেয়ে বসেছিল পবিত্রাকে। নিজে যোগাযোগ করেছিল বনদপ্তর-এর এক কর্তার সঙ্গে, তিনি বলেছিলেন এই গ্রামকে বদলাতে দরকার অর্থনীতির পরিবর্তন , আর সেটা সম্ভব তখনই হবে যখন পর্যটকরা এই গ্রামে এসে থাকতে শুরু করবেন। যে সময়টার কথা বলা হচ্ছে তখনো হোমস্টে ব্যাপারটা চালু হয়নি। প্রথমবার অচেনা চারজন পুরুষকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে পবিত্রাই ওই গ্রামে এই হোমস্টে বিষয়টার প্রবর্তন করে। তারপর ধীরে ধীরে ওই গ্রামের অর্থনীতি পাল্টে ফেলে পবিত্রা, এখন ওই গ্রামে মোট ১৩ টা হোমস্টে। 

পবিত্রার কথায় মাত্র ৫০০ টাকা পুঁজি নিয়ে সে কাজ শুরু করেছিল, ছোট্ট একফালি ঘরে পবিত্রা খুব বেশি মানুষকে জায়গা দিতে পারত না, অনেক কষ্ট করে দুটো মাটির ঘর তৈরি করেছিল, সেই সময় সেই ঘর দুটো সাজানোর ক্ষমতাও ছিলনা পবিত্রার। প্রথমবার এই চারজন পর্যটক পবিত্রাকে কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছিল , সেই টাকায় পবিত্রা ওই ঘর সাজিয়েছিল। আর ওই চারজন পর্যটককে পবিত্রা অনুরোধ করেছিল তারা যেন এই গ্রামের কথা অন্যান্য মানুষদেরও জানায় , ধীরে ধীরে চুইখিম গ্রামের কথা ছড়িয়ে পড়তে থাকে অন্য মানুষদের মধ্যে। প্রায় দু'দশকের চেষ্টায় পবিত্রার অনুপ্রেরণা এবং উৎসাহে চুইখিম গ্রামে ১৩ টি হোমস্টে তৈরি হয়েছে। এই গ্রামের বাইরে যাঁরা কাজ করতেন তাদের মধ্যে অনেকেই ফিরে আসাও শুরু করেছেন। পবিত্রা জানেন যে সময় তিনি এই কাজ শুরু করেছিলেন তখন রীতিমতো কটুক্তি সহ্য করতে হয়েছে তাকে। তবে বনদপ্তর থেকে সাধ্যমত সাহায্য পেয়েছে পবিত্রা। এমনকি বনদপ্তর থেকে পবিত্রা ছাড়াও অন্যান্য পরিবার কেও যখন হোমস্টে গড়ার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানায়, পবিত্রা ছাড়া কেউ এই উদ্যোগের শামিল হতে চায়নি। তবে পবিত্রা একাই পাল্টে দিয়েছে এই গ্রামকে। এমনকী নানা অসামাজিক কাজকর্ম হতো ওই গ্রামে, অর্থনীতির বদল আসায় পাল্টেছে সবটাই।

চুইখিম এখন ভলিন ট্যুরিজমের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। ভলিন ট্যুরিজমের অর্থ হল ভল্যিউনটারি ট্যুরিজম। অর্থাৎ যে সমস্ত পর্যটকরা স্বেচ্ছায় এই গ্রামে এসে গ্রামের উন্নয়নের জন্য কিছু কাজ করেন। অনেক এনজিওর তরফেও চুইখিম-এ কাজ হয়েছে। তবে সবটাই পবিত্রার উদ্যোগে। দেশের বাইরে থেকেও অনেক পর্যটক এসে এখানে কাজ করেছেন। 

chu

শুধু অর্থনীতি নয়, পবিত্রার হাত ধরে এই গ্রামে অনেক সামাজিক বদলাও ঘটেছে। যে গ্রামে শুধুমাত্র প্রাইমারি স্কুল ছিল সেখানে এখন উচ্চ বিদ্যালয় তৈরি হয়েছে। ওই গ্রামে যে সমস্ত মানুষরা থাকতে গেছেন পবিত্রা নিজের উদ্যোগে সকলকে গ্রামে স্কুল না থাকার আক্ষেপের কথা জানিয়েছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক দেবাশীষ ভট্টাচার্য চুইখিমে স্কুল তৈরির ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছেন। প্রথমে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত স্কুলটি খোলা হয়েছিল তারপর দশম শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছে। এভাবেই চুইখিম এখন পবিত্রার দেখানো আলোয় ঝলমল করছে।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...