১৯৩৭ সাল। এ দেশই তখন অসহনীয় নৈরাজ্যের অধীনে, স্বাধীনতার স্পৃহায় রণসাজে প্রস্তুত হচ্ছে দেশবাসী; মেয়েদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে আলাদা করে ভাবতে শেখার সামগ্রিক উন্মুক্ত পরিসর তখনও তৈরী হয়নি। সতীদাহ, বাল্য বিবাহ, বিধবা বিবাহের অমানবিক দুর্বিষহ থেকে আইনত পাশ করে গেলেও কালো নেশার মতো নাছোড় কিছু অন্ধ অনুরোগ-গোঁড়ামি-অপবিশ্বাস –এসবের মরীচিকায় মুগ্ধ হয়ে মুক্তবিচারে ডাঁহা ফেল করে বসেছিল ভারতবাসী। সেই সময়কারই কথা। সেইরকম সময়েই সমস্ত ব্যাঘাতকে দূরে রেখে স্বাধীন-অবাধ এগিয়ে চলার স্বাধিকার তৈরি করে নিয়ে দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন যে সব ফুলেদের দল, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন- ‘এ ললিতা’।
দায়িত্ব কাকে বলে পদে পদে উপলব্ধি করতে যখন তিনি শুরু করলেন তখন তাঁর বয়স ছিল আঠারো। দায়িত্ব- একা হাতে সংসার সামলে চারমাসের মেয়েকে বড় আর মানুষ করার। একা হাতে কারণ, তিনি যখন চারমাসের এক ফুটফুটে কন্যের মা তখনই তিনি হারিয়েছিলেন তাঁর দাম্পত্যজীবন; স্বামীকে। হয়ে উঠেছিলেন সে সময়ের ‘সিঙ্গল মাদার’।
সাল- ১৯৩৭। সময় বার বার উল্লেখ করার কারণ, মাথা মুণ্ডন করানো, কঠোর সীমাবদ্ধ জীবন, সমাজ থেকে নির্বাসন, ‘সতী’ প্রথা –এসব চরম অভ্যেসের ছায়া তখন মাদ্রাস(বর্তমানে চেন্নাই) তথা এ দেশ থেকে সরে গেলেও একজন যুবতী বিধবার প্রতি সামাজিক চিন্তাধারার মানদণ্ড ছিল ঘাতকের মতো করুণ। কিন্তু ললিতা ছিলেন সে সবের উর্দ্ধে; তাই তিনি সমসাময়িক সমস্ত ব্যাঘাত দূরে সরিয়ে রেখে বেছে নিয়েছিলেন নির্ভীকতা, এগিয়ে চলা। বৈধব্য ও শিশুকন্যা সামলে পড়াশোনা শেষ করেন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। শুধু তাই নয় সেই ভয়ংকর পুরুষ-সমাজতন্ত্রের মুখে কালো-চুন লেপে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনিই হবেন দেশের সর্বপ্রথম মহিলা ‘ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার’। নিজের কথা রেখেছিলেন ললিতা।
১৯১৯ সালের ২৭ আগস্ট-এ এক মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল তেলুগু পরিবারে জন্ম নেন এ ললিতা। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম জন। বৈষম্যের বাতাবরণে বড় হয়েছিলেন তিনি। পরিবারে নিয়ম ছিল ছেলেদেরকে হতেই হবে ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু মেয়েরা পাবে কেবলই প্রাথমিক শিক্ষা। কিন্তু ললিতার ‘ইঞ্জিনিয়ার’ বাবা ললিতাকে দশম শ্রেণী উত্তীর্ণ করিয়ে তবেই তাঁকে পাত্রস্থ করেছিলেন। ললিতা বিবাহিত জীবন শুরু করেছিলেন ১৫ বছর বয়সে।
১৯৭৯ সালে মারা যান ললিতা। তাঁর সেই চারমাসের মেয়ে শ্যামলা চেনুলু এখন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত ‘ইঞ্জিনিয়ার’। মায়ের জুতোতে পা গলিয়েছেন মেয়েও। এক সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শ্যামলা তাঁর মায়ের ‘স্ট্রাগল’ এর কথা মনে করে বলেন, “বাবা মারা যাওয়ার পর মা কে দেখেছি অমানবিক পরিশ্রম করতে। আমার বাবার মা অর্থাৎ আমার ঠাকুমা তাঁর ষোল তম সন্তানকে হারিয়ে যাবতীয় অবসাদ উগরে দিতেন মায়ের উপর। তবে আমি এখন বুঝতে পারি উনি তখন যে আচরণ করতেন তা তিনিও ধারাবাহিকতায় পেয়েছিলেন একদিন। যাইহোক, এসবের মধ্যেই আমার মা সেইসময় সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন সমস্ত সামাজিক চাপকে অগ্রাহ্য করে নিজেকে শিক্ষিত করবেন এবং নিজের জীবনের জন্য বেছে নেবেন একটি সম্মানীয় জীবিকা।“
সে সময় মেয়েদের ডাক্তারি পড়ার বেশ প্রচলন শুরু হয়েছিল। কিন্তু ললিতা ডাক্তার হতে চান নি। তিনি চান নি তাঁর দুধের শিশুকে ফেলে রাত বিরেতে বেরিয়ে পড়তে হয়, এমন কোনও পেশার সঙ্গে লিপ্ত হতে। তাই তিনি ৯ টা- ৫ টা’র পেশাই বেছে নিতে চেয়েছিলেন মেয়ের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর জন্য।
ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েও তাঁকে বেশ কসরত করতে হয়েছিল। কারণ, তিনি ছিলেন মাদ্রাস কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রথম মহিলা ছাত্রী। কলেজ কর্তৃপক্ষের সহায়তায় কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিলেন। মায়ের স্মৃতিচারণায় শ্যামলা আরও বলেন, “অনেকেরই অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে যে কলেজে্র ১০০ জন ছেলে পড়ুয়ার মধ্যে একমাত্র তিনিই ছিলেন মহিলা, অথচ কোনও দিন একটিবারের জন্যও কোনও অসুবিধা হয় নি মায়ের। খুবই সহযোগীতা পেতেন মা। এমনকি মায়ের জন্য আলাদা হস্টেলের ব্যবস্থা করে দেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। আমি তখন এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের বাড়িতে থাকি, মা সারা সপ্তাহ কলেজ করে সপ্তাহান্তে দেখা করতে যেত আমার সঙ্গে।“
গ্রাজুয়েশন শেষে ললিতা যোগ দেন শিমলার ‘সেন্ট্রাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন’-এ। মজার বিষয় হল তিনি যেহেতু কলেজের প্রথম মহিলা ছাত্রী ছিলেন সেহেতু তাঁর গ্রাজুয়েশন সার্টিফিকেটও তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘He’ হিসেবেই। পরে অবশ্য তা পরিবর্তন করে ‘she’ করা হয়।
বদলির চাকরিতে শেষে এসে পৌঁছেছিলেন কলকাতায়। যুক্ত হয়েছিলেন ইলেক্ট্রিকাল ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে। শ্যামলা বলেন, “আমার এক আত্মীয় কলকাতায় থাকতেন। মা যখন কলকাতায় এলেন আমি বেশিরভাগ সময় ওদের সঙ্গে কাটাতাম। তখন আমি ভাবতাম আমার মা বোধহয় আর পাঁচজন ইঞ্জিনিয়ারের মতোই একজন, অনেক পরে আমি বুঝতে পারি আমার মা সাধারণ নন। সে সময়ের নিরিখে বিধবা মহিলা সঙ্গে শিশুকন্যা , অসহনীয় পরিশ্রম করে তিনি অর্জন করেছিলেন দেশের প্রথম মহিলা ইঞ্জিনিয়ারের সম্মাননা।“
সত্যিই তাই। ললিতারা সাধারণ নন বলেই এখনও কত শত ফুলের দল অনুসরণ করার মতো উদাহরণ খুঁজে পায়, অসাধারণ হয়ে ওঠার সাহস পায় লড়াই করে।