মেয়েটা নির্ভীক পায়ে হেঁটে চলেছে সুন্দরবনের জল-কাদা মাখা খাঁড়ি দিয়ে। এই ভাবেই মধু সংগ্রহ করে ও। মেয়ে হয়ে এতটা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা, সহজ ছিল না মোটেই। তাও আবার শহরের বাইরে প্রান্তিক একটা অঞ্চলে, যে প্রান্তিক অঞ্চলের নাম সুন্দরবন। তাও লড়াকু সাহসী মেয়ে বলে খানিক কুর্নিশ জানানো যেত, দেখা গেল মেয়েটার মুখের ক্ষত ওকে থামাতে পারছে না, তাই ওকে নিয়ে আড়ালে আরো ব্যঙ্গ শুরু হলো। সুন্দরবনের প্রান্তিক জায়গাটার মেয়েটা কি তাহলে থেমে গেল? মোটেই না। বরং আরো উদ্যমে সুন্দরবনের রুবি শেখ এগিয়ে চলেছিল।
অল্প বয়সেই অ্যাসিডে আক্রান্ত হয় রুবি শেখ। বাবা অতি সাধারণ দিনমজুর। মা গৃহবধূ। এমন একটা পরিবারের মেয়ে হয়ে এই চরম অন্ধকারময় একটা দুর্ঘটনায় পড়ার কারণ! যেমনটা হয় সাধারণত, প্রেমের প্রস্তাবে না বলা। অতএব পুড়িয়ে ছারখার করে দাও! রুবি শেখের সঙ্গে ঠিক এমনটাই হয়েছিল। অ্যাসিড আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসায় দীর্ঘ বছর লাগে শরীরের ক্ষত সারাতে। ক্ষতটা শুধু শরীরে ছিল না, গভীরে ক্ষত দানা বেঁধে ছিল মনেও।
শরীর ছাড়াও নানা মানসিক অসুস্থতা সারানোর থেরাপির মধ্যে দিয়েও যেতে হয় রুবিকে। একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে রুবি, বাইরের খোলসের মতো আবরণটাই যে সব নয় নিজেকে প্রতিনিয়ত বোঝাতো রুবি, পরিবার যথাসম্ভব পাশে দাঁড়িয়েছিল। বাংলায় স্নাতকোত্তর এবং ডি এল এড করেন রুবি। অনেক কটুক্তি, ব্যঙ্গ, হাস্যকর মন্তব্যকে নিজের আত্মবিশ্বাস দিয়ে একটু একটু করে চাপা দিতে শুরু করে রুবি। কিন্তু চাকরি পাওয়া সহজ ছিল না।
একদিন ট্রেনে ফেরার সময় আত্মহত্যার কথাও মনে হয়েছিল রুবির। সেদিন কেউ না আটকালে হয়তো নিজেকে শেষ করে ফেলতেন। কে আটকেছিল? একপ্রকার দৃষ্টিভঙ্গি। ট্রেনে একজন ব্যবসায়ী মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়। ট্রেনে ঘুরে ঘুরে সে রোজকার নানা জিনিসপত্র বিক্রি করে। পরিবারের পেট চালানোর জন্য মেয়েটি পড়াশোনাও ছেড়ে দিয়েছিল। রুবির অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে এই মেয়েটি।
সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যা পাওয়া যায় এই রাজ্যের কোন জায়গাতেই তার বিকল্প হয় না। সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ করার কাজ শুরু করে রুবি। কৃত্রিম নয়, একেবারে ভেজালহীন। রুবি ব্যবসা শুরু করে। সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ করে তা কলকাতায় বিভিন্ন ডিলারের কাছে পৌঁছে দিতে থাকে রুবি। প্রথমদিকে একেবারে অর্ডার হত না। তবে রুবি হাল ছাড়েনি।
সপ্তাহে হয়তো খুব সামান্য কিছু অর্ডার আসত, তবুও রুবি নিজের উদ্যমে শুরু করা এই ব্যবসাটাকে কখনো বন্ধ করেনি। ধীরে ধীরে আচার, ঘি এগুলোও বাড়িতে তৈরি করতে থাকে রুবি, ভেজালহীন হাতে তৈরি এই খাবার যদি পৌঁছে দিতে থাকে সাধারণ মানুষের কাছে, কলকাতার বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করতে থাকে রুবি, ধীরে ধীরে নিজের পরিচয় খুজে পায় মেয়েটা, সে বুঝতে পারে জীবন কাউকে খালি হাতে ফেরায় না।
মাত্র ২৫ কেজি মধু প্রসেস করা দিয়ে রুবি শুরু করেছিল তার কাজ, তারপর থেমে থাকতে হয়নি, অনেক কুইন্টাল মধু রুবি তৈরি করে এখন, সারা দেশে পৌঁছে যায় রুবির তৈরি করা খাবার। সুন্দরবনে যেখানে অনলাইন কেনাকাটা করার কোন সুযোগ সুবিধা ছিল না রুবির জন্য সেই সুযোগ খোলে, কুরিয়ারের কোন সুবিধা সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলটাকে ছিল না, রুবির তৈরি করা জিনিসপত্রের খাতিরেই সেই সুযোগও উন্মুক্ত হয়, রুবি শেখ । এখন মানুষ রুবিকে সুন্দরবনের রুবি শেখ হিসেবে চেনে, এভাবেই রুবি সমগ্র সুন্দরবনের চোখে স্বপ্ন এঁকে দিয়েছে।