জাতিসংঘের একটি বিশেষ বক্তৃতার আয়োজন করা হয়েছিল টেক্সাসে। উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি গ্রামের আনোয়ারা খাতুন কথা বলছিলেন ওই অনুষ্ঠানে। কথা বলতে বলতে বারবার তাঁর চোখ ভিজে আসছিল। শৈশবের স্মৃতি তাঁর কাছে যন্ত্রণাদায়ক। তিনি সকলকে বোঝাচ্ছিলেন ছোটবেলা থেকেই নিজের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হওয়া কতটা জরুরী। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শিশুদের যে বিষয়গুলো শেখানো জরুরি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবা-মায়েরা তা শেখায় না। কে এই আনোয়ারা খাতুন?
সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চল সন্দেশখালির আনোয়ারা খাতুন পাচার হয়ে গিয়েছিলেন ছোটবেলাতেই। তিনি মনে করতে চান না। তিনি বলছিলেন "আন্তর্জাতিক স্রোতাদের সামনে আমার গ্রামের গল্প বলা এবং সারা বিশ্বের গল্প শোনা আমায় একজন শিশু অধিকার কর্মী হিসেবে আরো শক্তিশালী করে তুলেছে। ছোটবেলায় আমি পাচার হয়ে যাওয়ার স্মৃতি মনে করতে চাই না। তবে তার পরের সময়টুকু ভয়ংকর ক্ষত হিসেবে আমার মনে আজও গেঁথে রয়েছে।" পাচার হয়ে যাওয়ার পরে দারিদ্র্যের কারণে শিশু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে হয়েছে আনোয়ারাকে। যদিও অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার প্ররোচনাও এসেছিল, কিন্তু আনোয়ারা সাহসের সঙ্গে, প্রত্যয় সঙ্গে সেই সম্ভাবনা এড়িয়ে যান।
কলকাতার একটি এনজিওর বদান্যতায় আনোয়ারা উদ্ধার হয়েছিলেন নিজের অন্ধকার জীবন থেকে। তবে উদ্ধার হয়ে তিনি পণ করেছিলেন যে, শিশুদের অধিকারের জন্য লড়াই করবেন। তাই নিজের কাজ হিসেবে সেই পথকেই বেছে নিয়েছিলেন। সেই এনজিওর হয়ে তিনি সরাসরি বিভিন্ন নামই মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করেন, শিশু অধিকারের জন্য কাজ করতে শুরু করেন তাঁদের সাহায্যে। আনোয়ারা সেইসব সাহায্যকারীদের নাম সরাসরি নেননি। আনোয়ারা মতে যারা তাকে সাহায্য করেছেন নিঃশর্ত এবং নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করেছেন। বেশ কয়েক বছর আগে জাতিসংঘের একটি উন্নয়নের লক্ষ্যে হওয়া শীর্ষ সম্মেলনে আনোয়ারা যোগ দিয়েছিলেন এবং পরের বছর তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভারতের শিশুদের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
শিশু অধিকার কর্মী হিসেবে আনোয়ারা খাতুন এর নাম এখন সুপরিচিত। জি বেসরকারি সংস্থাটির সঙ্গে তিনি যুক্ত তারা শিশুদের অধিকারের জন্য কাজ করেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা অন্ধকার পথ থেকে শিশুদের উদ্ধার করেন।
আনোয়ারা এখন সারা বিশ্বব্যাপী কাজ করছেন, আনোয়ারের মতে সমাজ এখনো অন্ধকার পথ থেকে ফিরে আসা মানুষদের গ্রহণ করে না। এই গ্রহণীয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করাটাও একটা লড়াই। আনোয়ারার মতে যখন তাঁরা জীবনের ক্ষেত্রে এগিয়ে চলার পথ পায় সে ক্ষেত্রে মানুষের এই গ্রহণ না করা তাদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
আনোয়ারা এবং তাঁর এনজিওর মেয়েরা এই ধরনের শিশু এবং মহিলাদের জন্যও লড়াই করেন। সারা বিশ্বের পাচার হয়ে যাওয়া মহিলাদের কথা ভেবে আনোয়ারের এই লড়াই কুর্নিশযোগ্য।
আনোয়ারের বয়স তখন সাত বা আট। আনোয়ারাকে পাচার করে দেওয়া হয়েছিল একটি অন্ধকার জায়গায়। তারপর সেখান থেকে গৃহকর্মী হিসেবে আবার পাচার হয়ে যায় আনোয়ারা। ছোটবেলার স্মৃতি বলতে কষ্ট, যন্ত্রণা, অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই। আনোয়ারা যখন এনজিওটির সাহায্যে উদ্ধার হয় তখন মানসিকভাবে অত্যন্ত বিপর্যস্ত ছিলেন, তবে ধীরে ধীরে তাদের সাহায্যে আনোয়ারা হাতের কাজ শিখে রোজগার করা শুরু করেন। পরিবার আনোয়ারাকে সম্পূর্ণরূপে ফিরিয়ে না নিলেও একেবারে দূরে সরিয়ে রাখেনি। তবে যত বড় হয় আনোয়ারা বুঝতে পারেন এই ধরনের ঘটনা আটকানোর সবচেয়ে ভালো উপায় সচেতন হওয়া এবং সচেতন করা। আর কেউ যদি দুর্ঘটনাক্রমে কোনোভাবে পাচারের শিকার হন বা অন্য কোন দুর্ঘটনার শিকার হন তাদের ফিরিয়ে আনাই হবে আনোয়ারা-এর মূল লক্ষ্য। ২০১৬ সালে আনোয়ারা জাতীয় সংঘে নিজের কাজের জন্য স্বীকৃতি পান, এখনো শিশু অধিকার কর্মীদের হয়ে আনোয়ারা লড়াই করেন এবং শিশুদের অধিকারের জন্যও অনবরত লড়াই করে চলেছেন।