জন্মমুহূর্তে পর্যাপ্ত অক্সিজেন শিশুর মস্তিষ্কে পৌঁছালে বাড়তে পারে শিশুর বুদ্ধির বিকাশ। সাধারণত ডেলিভারির সময় শিশুকে গর্ভাবস্থায় থেকে বের করার সাথে সাথেই আম্বিলিকাল কর্ডটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। অনেক বছর ধরে এমন পদ্ধতি মেনেই প্রসব করানো হয়। সময় বাঁচানো এবং বেশি প্রসব করানোও এর আরেকটি উদ্দেশ্য। তবে মাত্র পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে আম্বিলিকাল কর্ড-এর সাথে যুক্ত নবজাতকের তুলনামূলক ভাবে বুদ্ধির বিকাশ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছেন কলকাতারই একজন বাঙালি চিকিৎসক। এ বিষয়ে কলকাতা এবং গুজরাট এর দুইটি হাসপাতালে, গত কয়েক বছর ধরে রীতিমত গবেষণা করেছেন তিনি। শিশু চিকিৎসক অরুন সিংহ-এর গবেষণা অনুযায়ী নবজাতকের জন্মের ঠিক পরেই আম্বিলিকাল কর্ডটি না কেটে সেই মুহূর্তে তাকে পাঁচ মিনিটের জন্য মায়ের বুকে শুইয়ে রাখা এবং প্লাসেন্টা স্বাভাবিক ভাবে বেরিয়ে না আসা অব্দি অপেক্ষা করা, নবজাতকের বুদ্ধি বিকাশে বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারে।
আম্বিলিকাল কর্ড তাৎক্ষণিক ভাবে কেটে ফেললে শিশুটি বেরিয়ে আসবার সাথে সাথে বাইরে থেকে অক্সিজেন নেবার চেষ্টা করে থাকে। যেটা স্বাভাবিক ভাবেই দীর্ঘসময় একই ভাবে থাকবার কারণে হঠাৎ করে নতুন পদ্ধতিতে অক্সিজেন নেবার ক্ষেত্রে কিছু কষ্ট হতে পারে। বিশেষত, মস্তিষ্কে সেই মুহূর্তের জন্য কম অক্সিজেন পৌঁছায়। অন্যদিকে নাড়ি না কেটে পাঁচ মিনিট ধৈর্য্য সহকারে শিশুটিকে মায়ের বুকে শুইয়ে রাখলে, আম্বিলিকাল কর্ড থেকেই তখন অক্সিজেন নিতে সক্ষম হয় নবজাতকটি। জন্ম মুহূর্তে পর্যাপ্ত অক্সিজেন মস্তিষ্কে পৌঁছে গেলে বুদ্ধির বিকাশে তা বিশেষ ভাবে সহায়ক হয় বলে জানিয়েছেন শিশু চিকিৎসক অরুন সিংহ। এ ছাড়াও নিয়ম অনুযায়ী, শিশুকে জন্মের এক ঘন্টার ভিতরেই মায়ের স্তন্যপান করাতে হয়। তবে আম্বিলিকাল কর্ড না কেটে তখনি মায়ের বুকে শুইয়ে রাখলে শিশুটিকে স্তন্যপান করানোও সম্ভব হবে।
প্রসবকালীন এই বিশেষ রিসার্চ পেপারটি সম্প্রতি আমেরিকান জার্নাল অব পেরিনেটোলজি -তে গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের অন্যান্য হাসপাতালগুলিতে এ বিষয়ে সচেতন করে দিতে উদ্যোগী হবেন বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। পুরুলিয়ার সদর হাসপাতালে সিক নিউ বর্ন কেয়ার ইউনিট (এসএনসিইউ) -এ এই পদ্ধতি অবলম্বন করে নবজাতকের মৃত্যুর হার কমিয়ে এনেছিলেন শিশু চিকিৎসক অরুন সিংহ। পুরুলিয়া থেকেই এর প্রচলন শুরু হয় বলে এর নাম দেওয়া হয় পুরুলিয়া মডেল। এ রাজ্য ছাড়াও অন্যান্য রাজ্য এবং প্রতিবেশী দেশেও পরবর্তীতে এই পদ্ধতি অনুসরণ করবার দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যায়। ডাক্তার অরুন বাবুর গবেষণা অনুযায়ী যেসব শিশুদের জন্মের পরপরই আম্বিলিকাল কর্ড কেটে দেওয়া হয়েছে তাদের তুলনায় যাদের স্বাভাবিক সময় মত প্লাসেন্টা বেরিয়ে আসা অব্দি কর্ডটি কাটতে অপেক্ষা করা হয়েছে তাদের মস্তিষ্কে অক্সিজেনের পরিমান বেশি ছিল। কলকাতার এসএসকেএম এবং গুজরাটের একটি সরকারি হাসপাতালে এই গবেষণা করেছেন অরুন বাবু।
সদ্যজাতর নাভি এবং প্লাসেন্টার মধ্যবর্তী টিউবটি প্রায় ২০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে থাকে। রক্ত চলাচল করে টিউবটি দিয়ে। প্রসব মুহূর্তে কর্ডটি ৪ বা ৫ সেন্টিমিটার বের হলেই কেটে দেওয়া হয় কিন্তু মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করলে প্লাসেন্টা আপনিই বেরিয়ে আসে বলে জানিয়েছেন ডাঃ অরুন সিংহ। তিনি বলেন মাতৃগর্ভে শিশু একটা দীর্ঘ সময় অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইডের ভিতরে থাকে। প্লাসেন্টার মাধ্যমে শিশু প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সংগ্রহ করে থাকে কিছু জন্ম মুহূর্তে তা বিচ্ছিন্ন করলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন প্রবেশে সমস্যা হতে পারে। ঠিক ওই সময়েই পাঁচ মিনিটের জন্য অক্সিজেন মস্তিষ্কে প্লাসেন্টার মাধ্যমে প্রবেশ করলে তা বুদ্ধির ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। এই সময়টুকুতে যেমন মায়ের স্তন্যপান করানোর সুযোগ থাকছে এছাড়াও প্লাসেন্টা কাটবার সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ থেকে বিরত থাকার সুযোগ থাকে। ডাক্তার অরুন সিংহের এই গবেষণাকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন শিশু চিকিৎসকদের একটি বৃহৎ অংশ।