বাংলাদেশের বরিশাল শহর থেকে তের মাইল দূরে শিকারপুর গ্রাম। পৌরাণিককালে এই গ্রামের নাম ছিল ‘সুগন্ধা’। গ্রামের পাশ দিয়ে কুলুকুলু রবে বয়ে যেত যে নদীটি, তারও নাম ছিল ‘সুগন্ধা’। সেই পৌরাণিককাল পেরিয়ে এখনও নদীটি বইছে। তবে তার ধারা ক্ষীণ হয়েছে। আর নাম হয়েছে, ‘সোন্ধ’। আর গ্রামের নাম পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে, ‘শিকারপুর’।
আসলে, সেই পৌরাণিক যুগ থেকে কালেরগতিকে নদীর নাম লোকমুখে পরিবর্তিত হতে হতে আজ ‘সুগন্ধা’ থেকে ‘সোন্ধ’ হয়েছে। গ্রামনাম পরিবর্তনের পেছনেও কারণ রয়েছে। কিংবদন্তি থেকে জানা যায় যে, সুগন্ধা নদীর তীরে যে জঙ্গলটি ছিল, সেটিকে লোকে বলত ‘সুগন্ধার জঙ্গল’। আর জঙ্গললাগোয়া যে ছোট্ট জনপদটি ছিল, নদীর নামে তার নামও হয়ে উঠেছিল ‘সুগন্ধা’। জঙ্গলে ছিল বিভিন্ন ধরণের বন্যজীবজন্তু ও পাখি। রাজা-রাজড়ারা নিয়মিত সেখানে আসতেন মৃগয়া অর্থাৎ শিকার করতে। তাঁদের ‘শিকার’-এর ক্ষেত্র হিসেবেই জঙ্গল ও জনপদ ধীরে ধীরে লোকমুখে ‘সুগন্ধা’ থেকে হয়ে উঠেছিল ‘শিকারপুর’।
যাই হোক, প্রাচীন সুগন্ধা পৌরাণিক গ্রন্থে বন্দিত হয়েছে সতীপীঠ হিসেবে। ‘পীঠনির্ণয়তন্ত্র’-গ্রন্থে অনুযায়ী সুগন্ধা হল দেবীর একান্নপীঠের মধ্যে তৃতীয়পীঠ। এখানে সতীর নাসিকা পড়েছিল। দেবীর নাম ‘সুনন্দা’; আর দেবীর ভৈরবের নাম, ‘ত্র্যম্বক’। ‘পীঠনির্ণয়’-এ লেখা হয়েছে—
‘সুগন্ধায়াঞ্চ নাসিকা দেবস্ত্রম্ব্যকনামা চ সুনন্দা তত্র দেবতা।’
শুধু তন্ত্রগ্রন্থ নয়, পরবর্তীকালের মঙ্গলকাব্যেও এই পুণ্যপীঠের মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে। আঠের শতকের কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে সুগন্ধাপীঠের উল্লেখ করে লিখেছেনঃ
‘সুগন্ধায় নাসিকা পড়িল চক্রহতা।
ত্র্যম্বক ভৈরব তাহে সুনন্দা দেবতা।।’
উক্ত দুই পৌরাণিকগ্রন্থে দেবীর ভৈরবের নাম ‘ত্র্যম্বক’ হিসেবে উল্লেখ থাকলেও অনেকেই তাঁকে ‘বটুকেশ্বর’ নামেও অভিহিত করে থাকেন। তিনি থাকেন দেবীর মন্দির থেকে তিন মাইল দূরের সামরাইল গ্রামে।
আমরা জানি যে, যেখানে যেখানে দেবী সতীর অঙ্গ বা ভূষণ ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে পতিত হয়েছে, সেই সেই স্থানেই দেবীর এক-একটি জাগ্রত পীঠ গড়ে উঠেছে। আমরা এও জানি যে, দেবীর অঙ্গ বা ভূষণ ভূমিতে পতিত হওয়ার পর তা শিলায় পরিণত হয়েছে এবং তা লোকচক্ষুর অন্তরালে গোপন থেকেছে। তারপর নিয়ত আবর্তিত মহাকালের কোন এক ক্ষণে দেবীর যখন ইচ্চছা হয়েছে অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে ভক্তের সামনে এসেছেন, তার পুজো নিয়েছেন, কৃপা করে অধিষ্ঠিতা হয়েছেন। সুগন্ধা বা শিকারপুর গ্রামে দেবী কীভাবে প্রকট হলেন, কীভাবে তাঁর পীঠ ভক্তের আশ্রয় হয়ে উঠল, তাই নিয়ে একটি কিংবদন্তি রয়েছে। সেটাই এখন বলছি, শুনুনঃ
সুগন্ধা নদীর ধারের জঙ্গলটিতে বন্য জীবজন্তুর ভয় থাকলেও গোচারণের উপযুক্ত ঘাস ছিল বিস্তর। তাতে পাঁচ গাঁয়ের রাখাল আসত গরু চরাতে। বেশ কিছুদিন কোন ঝামেলা ছাড়াই জঙ্গলে তাদের গোচারণ চলল। কিন্তু হঠাৎ একদিন পাঁচ গাঁয়েরই গাভীর মালিকেরা রাখালদের তলব করল। তাদের অভিযোগ, রাখালরা জঙ্গলে চরাতে নিয়ে গিয়ে গাভীর দুধ দুয়ে বিক্রি করছে, কেননা, গাভীগুলো বাড়িতে ফিরে আর দুধ দুইতেই দিচ্ছে না। নিরপরাধ রাখালরা তো অভিযোগ শুনে অবাক। তারা তিন সত্যি করে বলল যে, একাজ তারা মোটেই করে না। তবে বাড়িতে ফিরে গাভীরা দুধ যখন দিচ্ছে না, তখন নিশ্চয়ই দুধ চুরি তো কেউ করছেই। আর সেই চোর ধরেই তারা নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করবে। অবশ্য তার জন্য তারা ক’দিন সময় চেয়ে নিল। তাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে মালিকেরা ক্ষমাঘেন্না করে খানিক সময় দিয়েও দিল।
পরদিন থেকে রাখালরা জঙ্গলে গরু চরাতে গিয়ে গাভীদের ওপর খুব করে নজর রাখতে লাগল। এবং একসময় হঠাৎ-ই তারা খেয়াল করল যে, একটি ঝোপের মধ্যে গাভীরা একে একে ঢুকে একটি ঢিবির ওপর গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, আর অমনি আপনা আপনি তাদের পালান থেকে অঝোরধারায় দুধ ঝরে পড়ছে। সব ক’টা গাভী এভাবেই দুধ ঝরাল, কিন্তু মাটি বেয়ে এক ফোঁটা দুধ কোথাও গড়িয়ে পড়ে নষ্ট হল না। মনে হল যেন ঢিবি বেয়ে অত অত দুধের সবটুকুই পাতালে চলে গেল। এই অলৌকিক আশ্চর্য ব্যাপার দেখে রাখালেরা খুব ভয় পেয়ে গেল। তারা ছুটে গেল মালিকদের খবর দিতে। কিন্তু এমন অদ্ভুত কথা মালিকরা বিশ্বাসই করল না। তারা একযোগে বলল যে, পরদিন তারা নিজের চোখে দেখবে, তারপর যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেবে। আর যদি প্রমাণ হয় যে রাখালরা মিথ্যে বলছে, তাহলে জমিদারের দরবারে নিয়ে গিয়ে গর্দান নেওয়াবে!
কিন্তু কী অদ্ভুত, পরদিন মালিকরা গিয়েও সেই একই কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গেল। আর তারই মধ্যে তাদের কয়েকজনের দুর্বুদ্ধি হল, তারা ঢিবির রহস্য বুঝবার জন্য ঢিবির চারপাশে জমে থাকা শুকনো পাতার স্তূপে আগুন ধরিয়ে দিল। আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতেই লালপাড় শাড়ি পরা কৃষ্ণবর্ণা এক নারী সেই ঢিবি থেকে বেরিয়ে বাতাসের বেগে ছুটে গিয়ে সুগন্ধা নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এই অশৈলীকাণ্ড দেখার পর আর কেউ সেখানে থাকার সাহস করল না, সকলেই যে যার ঘরের দিকে ছুট দিল।
সেই রাত্রেই এই অঞ্চলের জমিদার রামভদ্র রায়কে মহাদেব স্বপ্নে আদেশ দিলেন। বললেন যে, তিনি জঙ্গলের মধ্যেই এক ঢিবির মধ্যে রয়েছেন, তাঁকে উদ্ধার করে পুজো করলে সকলের মঙ্গল হবে। পরদিন সকালে রাখাল ও গাভী মালিকদের দেখা অলৌকিক ঘটনার কথা লোকের মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে এসে পৌঁছল রামভদ্রের কানেও। তিনি ঢিবি, জঙ্গল ও গত রাত্রের স্বপ্নের কথা মিলিয়ে ইশারা বুঝলেন। তখন লোকলস্কর নিয়ে গিয়ে রাখালদের সহায়তায় সেই ঢিবি খুঁজে বের করে, সেটা খুঁড়ে মহাদেব ‘ত্রম্ব্যক’কে উদ্ধার করলেন। কিন্তু সেই স্থান থেকে শিবলিঙ্গকে টলাতে পারলেন না। তাই সেই স্থান পরিষ্কার করে সেখানেই তৈরি করে দিলেন মহাদেবের থান। দেবতারথানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠল বসতি, কালক্রমে সেই বসতির নাম হল, ‘সামরাইল’।
এদিকে মহাদেব প্রতিষ্ঠিত হতেই সুগন্ধা গ্রামের পঞ্চানন চক্রবর্তী নামের পূজারি ব্রাহ্মণকে স্বপ্নে দেখা দিলেন দেবী আদ্যাশক্তি। বললেন যে, তিনি সতীঅঙ্গে সুগন্ধা নদীর বুকে শিলারূপে বিরাজ করছেন। তাঁকে তুলে এনে স্বগ্রামে যেন প্রতিষ্ঠা করেন পঞ্চানন। তাতে জগতের মঙ্গল হবে।
দেবীর আদেশ পেয়ে পঞ্চানন নদীর বুক থেকে শিলারূপী দেবীর নাসিকা উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা করলেন। খবর পেয়ে রামভদ্র একখানা মন্দির তৈরি করে দিলেন। শুরু হল মন্দিরে শাক্ত ও সন্তানভক্তদের আনাগোনা। তাঁদের মঙ্গলস্রোতে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ল পীঠমাহাত্ম্য। সুগন্ধা তথা শিকারপুর হয়ে উঠল জাগ্রত শাক্ততীর্থ। দেবী কৃষ্ণাকালীরূপে রাখাল ও গাভীমালিকদের দেখা দিয়েছিলেন, দেবীর আবাসে তারা আগুন জ্বালিয়েছিল, সন্তানবতী মায়ের মতোই দেবী তবু তাদের কোন ক্ষতি করেননি। ক্ষতি হতে দেননি। তাই দেবী সকলের প্রিয় মঙ্গলময়ী তারামা। ভক্তদের কাছে তাঁর পীঠ তাই ‘তারাবাড়ি’ নামেই বিখ্যাত।
দুঃখের কথা, দেবীর সেই প্রাচীন মন্দির বহুকাল হল ভেঙে পড়েছে। দেবী সতীর শিলারূপী নাসিকা আবার লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছে। তাঁকে এখন আর দেখা যায় না। পরিবর্তে সেই স্থানে আবারও মন্দির তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে দেবীর বিগ্রহও। শবের উপর দণ্ডায়মানা দেবীর চারটি হাত। চার হাতে ধরা আছে খেটক, খড়গ, পদ্ম ও করোটি। মূর্তিতে তিনি উগ্রা, উগ্রতারা; কিন্তু বাৎসল্যের আধারে ভক্তের আশ্রয়। মূর্তিটি কয়েক শতাব্দী প্রাচীন। কেননা বিশেষজ্ঞদের মতে তাতে বৌদ্ধসংস্কৃতির ছাপ রয়েছে। তাই বলা যায়, দেবী প্রকট হওয়ার পর থেকে আজও তাঁর প্রশস্ত হৃদয়ে দীন-হীন, ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা, শাক্ত-বৌদ্ধ সকলকে এক করে সকলকে বুকে ধরে মাতৃময়ী করুণাদাত্রীরূপে সকলের মঙ্গল করে চলেছেন। আর তাঁর সেই মঙ্গলস্পর্শ পেতে প্রতি বছর শিবরাত্রির তিনদিনব্যাপী বিশেষ পুজো ও মেলায় উপচে পড়ে দেশ-দেশান্তরের ভক্তদের ভিড়।