দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার গাজিপুরে সলিল চৌধুরী জন্ম গ্রহণ করলেও ছোটবেলা কেটেছে আসামের চা বাগানে। বাবা জ্ঞানেন্দ্র চৌধুরীর চাকরির সূত্রে তিনি বড়ো হয়েছেন লতাবাড়ি চা বাগানে। ফলে আসামের ঐশ্বর্যশালী লোকসঙ্গীত ছোট থেকেই শোনার সুযোগ হয়েছিল।
অন্যদিকে বাবার কাছে পরিচয় ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে। বাখ, বেঠোফেন, চাইকস্কি, শপ্যাঁ এবং মোৎজার্ট কানে গেঁথে গিয়েছিল সেই অল্প বয়স থেকেই। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মেলবন্ধনের বীজ তখন থেকেই তাঁর মধ্যে ।
১৯৪৪ সাল। অসম ছেড়ে চলে এলেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন বঙ্গবাসী কলেজে। বাংলা সেই সময় অগ্নিগর্ভ। দেবব্রত বিশ্বাস, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখদের সঙ্গে সলিল চৌধুরীও যোগ দিলেন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে।
১৯৪৫ সালে বিদ্যাধরী নদীর জলে বানভাসি কৃষকদের নিয়ে সলিল গান লিখলেন। তাঁর প্রথম গণসঙ্গীত -"দেশ ভেসেছে বানের জলে ধান গিয়েছে মরে"।
কৃষক আন্দোলনের সময় লিখলেন - "কৃষক সেনাদের মুষ্টি তোলে আকাশে"। ১৯৪৬ সালে নৌ বিদ্রোহকে সমর্থন করে - "ঢেউ উঠছে কারা টুটছে"।
১৯৪৬ সালে তেভাগা আন্দোলনের সময় মানুষকে উত্তাল করে দিয়েছিল "হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো", "মানব না এ বন্ধনে, মানব না এ শৃঙ্খলে" বা "ও আলোর পথযাত্রীর" মতো অসংখ্য অবিস্মরণীয় গান।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সলিল চৌধুরীর আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন ভূপতি নন্দী। একটি গান তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে শুনিয়েছিলেন। সেই গান পরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অর্কেস্ট্রেশন করে রেকর্ড করেন। গানটি হল "কোনও এক গাঁয়ের বধূ"। সুরকার হিসেবে নাম দেন সলিল চৌধুরীর। এরপর শুরু হয় হেমন্ত-সলিল জুটি। "রানার", "অবাক পৃথিবী", "ধিতাং ধিতাং বোলে", "পথে এবার নামো সাথীর" মতো আরও অনেক গান।
গান রচনার পাশাপাশি কবিতা, গল্পও লিখতেন। তাঁর লেখা "রিক্সাওলা" গল্পটি পড়ে ভালো লেগে যায় পরিচালক বিমল রায়ের। সলিল চৌধুরীকে বম্বে ডেকে পাঠান। সেই গল্প নিয়ে তৈরি হল কালজয়ী ছবি "দো বিঘা জমিন"। চিত্রনাট্য লেখার পাশাপাশি ছবির সুরকার হিসেবেও কাজ করলেন সলিল। ছবি তো হিট করলই, ছবির গানও মুখে মুখে ফিরতে লাগল মানুষের।
"ধরতি কহে পুকার কে, বীজ বিছা লে প্যার কে, মৌসম বিতা যায়" আর "হরিয়ালা সাবন ঢোল বজাতা আয়" গানে মেতে উঠল গোটা দেশ।
‘দো বিঘা জমিন’ গানের রেকর্ডিং চলছে। স্টুডিওতে এসেছেন শচীন দেব বর্মন। পরিচালক বিমল রায়ের সামনে সলিল চৌধুরীকে বললেন - "জানস, আমার সুর মনে ধরে না আমার পোলাডার। ও পাগল তর সুরে। বারবার শুইনতে থাকে তর গান। আমারেও মানে না। পারিস তো এট্টু বোঝাস পঞ্চমরে।
এরপর বিমল রায়ের পরবর্তী ছবি "মধুমতী" সিনেমায়ও সলিল চৌধুরী সুর দেন। ছবি মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে ভারত মজে গিয়েছিল "মধুমতীর" গানে। "আজা রে পরদেশী", "চঢ় গয়ো পাপী বিছুয়া", "দিল তড়প তড়প কে কহ রহা হ্যায় আভিজা" আজও সমান হিট। এরপর তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। একের পর এক হিট গান উপহার দিয়েছিলেন।
‘আনন্দ’ সিনেমায় সুরকার সলিল চৌধুরী "কহী দূর জব দিন" এবং "মৈনে তেরে লিয়ে হি সাত রংকে সপনে চুনে" এই দুটি গান রেখেছিলেন গায়ক মুকেশের গলায়। "ব্যাকগ্রাউন্ড সং" হিসেবে রেখেছিলেন মান্না দের গাওয়া "জিন্দেগি ক্যাসি হ্যায় পহেলি" গানটি। রাজেশ খান্না বলেছিলেন- "আমি ছাড়ব না। এই গানটির লিপ আমিই দেব।" শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছিল। রাজেশ খান্নার লিপেই গান রাখা হয়।
‘অন্নদাতা’ ছবির "গুজর গয়ে দিন দিন দিন" গানটির রিহার্সালের জন্য কিশোর কুমার এসেছেন। গানটির সুর শুনে তিনি সলিল চৌধুরীকে বলেন- "আমাকে মাফ করুন সলিলদা, আপনার সমান উচ্চতায় বসে আমি এ গান শিখতে পারব না। কী সুর করেছেন"।
সলিল চৌধুরী ৭৫টির বেশি হিন্দি ছবি, ৪০ টির বেশি বাংলা ছবি আর প্রায় ২৬টি মালয়ালম ছবিতে সুর দিয়েছিলেন। এছাড়া মারাঠি, তামিল, তেলেগু, কন্নড়, গুজরাটি, ওড়িয়া এবং অসমীয়া চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন। সব মিলিয়ে মোট চোদ্দোটি ভাষায় তিনি গান বেঁধেছিলেন। তাঁর মৃত্যু ভারতীয় সঙ্গীত জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি। সলিল চৌধুরীর মৃত্যুর পর সঙ্গীত পরিচালক নৌশাদ বলেছিলেন- "From our seven notes, one is no more".