দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল দেশ। পর্দার আড়ালে থাকা মহিলারাও পথে মুক্তির দাবিতে। সেই সন্ধিক্ষণে অন্যরকম এক বিপ্লব ঘটালেন তামিলনাড়ুর এক মেয়ে।
পরিধানে ৯ হাতের মাদিসার। সাজ সজ্জা দেখে বোঝার উপায় নেই যে ভারতী চলচ্চিত্র জগতে কতবড় বিপ্লব এনেছিলেন তিনি। ১৯৩৭ সালে চেন্নাইতে অনুষ্ঠিত ক্যাথলিক ধর্ম সম্মেলনের ওপর একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন তিনি। মীনা নারায়নান ভারতের প্রথম মহিলা সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার।
রক্ষণশীল সমাজ। চারদিকে বিধি নিষেধের দেওয়াল। প্রথাভাঙা মেয়েদের দিকে সমাজের চোখ রাঙানি। ভারী কঠিন ছিল সে লড়াই। সেই সময় সিনেমার জগৎ সম্পর্কে মানুষের নানারকম ট্যাবু ছিল। পর্দার দুনিয়ায় আসা সহজ ছিল না। কিন্তু মীনা সিনেমার জগতে পা রেখেছিলেন। তবে ক্যামেরার সামনে নয়। তাঁর কাজ ছিল ক্যামেরায় ধরা শব্দকে ছবিতে যথাযথভাব রূপ দেওয়ার।
চলচ্চিত্র ঐতিহাসিক এস থিওডোর ভাস্করণ তাঁর গবেষণা গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘মীনা এবং তাঁর স্বামী ভাস্করণ দুজনেরই চলচ্চিত্র জগতে অবদান এত বেশি যে দুজনকে নিয়েই আলাদা আলাদা বই হয়ে যায়’।
মীনার বাবা সীতা রাম আইয়ার মাদ্রাজ হাইকোর্টের রেজিস্টার ছিলেন। তাঁর স্বামী নারায়ণা কেরিয়ার শুরু করেছিলেন ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে। ১৯৩৪ সালে কিলাপুক অঞ্চলে তিনি একটি ফিল্ম স্টুডিয়ো তৈরি করেন। সাউন্ড সিটি স্টুডিয়ো প্রথম টকি রেকর্ডিং স্টুডিয়ো।
নারায়াণান যখন তাঁর স্টুডিয়োতে বিখ্যাত সাউন্ড আর্টিস্ট পোদ্দারকে আনলেন তখন তাঁর স্ত্রী মীনাকে তাঁর সহকারী হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। তখন মীনা সবে হাই স্কুল পার করেছেন। কিন্তু সেই বয়স থেকেই ছবির দুনিয়ায় শব্দ ব্যবহারের প্রতিটি দিক, খুঁটিনাটি শিখতে শুরু করেছিলেন। প্রথম ছবি শ্রীনিবাস কল্যানম। সেই সময়ের ষাট হাজার টাকা বাজেট ছিল ছবিটির। ছবিটি ক্রাউন এবং ব্রডওয়েতে মুক্তি পেয়েছিল। সাড়া জাগিয়েছিল সিনেমা প্রেমিদের মধ্যে।
সে সময় সিনেমার সাউন্ড রের্কডিং- এর ক্ষেত্রে মস্ত সমস্যা ছিল প্রযুক্তি। টেকনিশিয়ান হিসেবে যারা কাজ করতেন তাঁদের বেশির ভাগেরই ভাষা এবং সিনেমায় ব্যবহৃত মিউজিক সম্বন্ধে নিয়ে সেভাবে কোনও ধারণা ছিল না। যে কারণে তামিল ছবির মান পড়ে যাচ্ছিল। মীনা নিজে গানের জগতের মানুষ ছিলেন। শুধু যে মিউজিক বুঝতেন তা নয়। নিজে গানটাও ভাল গাইতেন। প্রথাগত তালিমও নিয়েছিলেন দক্ষিণী সঙ্গীতের।
পোদ্দারের সঙ্গে কাজ করার পর তিনি নিজে কাজ শুরু করলেন। একের পর এক তামিল ছবিতে সাউন্ডের দায়িত্বে দেখা যেতে লাগল তাঁকে।
কিন্তু হঠাৎ এক বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়লেন মীনা। স্বামী নারায়ণার আচমকা মৃত্যু তাঁর জীবনকে অনেকটাই অন্তরালে ঢেলে দিয়েছিল। ক্রমশ সরে যান পেশার জগৎ থেকে।
তিনি থাকতেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী সি ভি রমনের বাড়িতে। তাঁর পুত্র-কন্যা অন্য পেশা বেছে নিয়েছিলেন।
১৯৫৪ তে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।