গল্প নয় সত্যি নায়িকার জবান

একটা সময়ে হিন্দি ছবিতে একটি সংলাপ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল- 'মর্দ কো দর্দ নেহি হোতা' 'মেল ডমিনেটিং' সমাজে অনেকটা মুখরোচক প্রবাদবাক্যের মতো প্রচলিত এই সংলাপ এখন আর শোনা যায় না বললেই চলে, কারণ এ প্রজন্ম চাইছে পরিবর্তন। গতানুগতিক সবকিছুকেই যুক্তিসঙ্গতভাবে পেরিয়ে চলার কথাই ভাবছে এ সময়, আর সেই কারণেই সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে ভারতের প্রথম 'স্টান্ট ওম্যান'- রেশমা পাঠান। ওয়েব সিরিজ শোলে গার্ল’-এ তুলে ধরা হয়েছে তাঁর কর্ম-কাহিনী।

 সমাজের নিয়মানুয়ায়ী সেসময়টা এমনই ছিল যে, এই 'মর্দ কো দর্দ নেহি হোতা' থিয়োরির চক্করে অন্তরালে থেকে গিয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ন মানুষ তথা মেয়েদের কথা। সেরকমই এক মহিলা রেশমা। কী এমন করেছিলেন রেশমা যেকারনে এতদিন পরে তুলে ধরা হচ্ছে তাঁর কাহিনী?

 তিনি সেসময় যা করেছেন তা এক কথায় 'অসাধ্য সাধন'ও বলে চলে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সাধারণ ঘরের মেয়েরা যখন পর্দানসীন হয়ে থাকতেন অথবা খিড়কী থেকে সিংহদুয়ার পৌঁছনোর আগে বেশ কয়েকবার ভাবতেন, তখন একজন হতদরিদ্র ঘরের মেয়ে হয়ে 'ছেলেদের মতো' মুক্ত আকাশে উড়েবেড়ানোর কথা ভাবতে পেরেছিলেন তিনি। এই উড়েবেড়ানোর স্বপ্ন তাঁকে দেখিয়েছিলেন বলিউডের জনপ্রিয় স্টান্ট ম্যান-অ্যাকশন ডিরেক্টর আজম খান

১৯৬২ সালের মুম্বই, দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থান বেশ টলমলে। দুর্ভিক্ষ, মহামারি, খ্যাদাভাবে ধুঁকছে গোটা দেশ। চালের চোরাচালান করতে গিয়ে ধরা পড়েন রেশমার মা, জেল হয় তাঁর। অন্যদিকে বাবা প্যারালাইসড। রেশমার বয়স তখন সবে নয়। পরিবারের হাল ফেরাতে জেলবন্দীদের বিড়ি সাপ্লাই আর ট্যাক্সির মাথায় সমারসল্টের ভেলকি দেখানোর কাজে লেগে পড়ে ছোট্ট রেশমা। এই খেলা দেখাতে গিয়েই সে চোখে পড়ে যায় আজম খানের। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে সিনেমায় কাজ করবে? বাবা রাজি হলেন না, কিন্তু কথায় আছে- পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে ১৯৭৪ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রথম সুযোগ 'এক খিলাড়ি বাহান পত্তে' ছবিতে। কিন্তু সিনেমায় রেশমা করবেন টা কী? তখন বলিউডের হিরোইন নিয়ে অ্যাকশন দৃশ্য করানোর একটা রেওয়াজ উঠেছিল, হিরোদের পাশাপাশি হিরোইনদের নিয়ে একটু 'অন্যরকম' করার চেষ্টা করছিলেন প্রযোজক-পরিচালকরা। কিন্তু বেশিরভাগ হিরোইনই অ্যাকশন দৃশ্যে সাবলীল হতে পারতেন না, 'ঝুঁকি' নিতে চাইতেন না। অতএব পুরুষ স্টান্টম্যানের পাশাপাশি প্রয়োজন পড়েছিল স্টান্ট-ওম্যানের। ভাত-কাপড়ের জন্য রেশমা নেমে পড়েছিলেন সেই 'ঝুঁকি'পূর্ণ কাজে। 'এক খিলাড়ি বাহান পত্তে' ছবিতে ক্যাবারে কস্টিউম পরে রিভলভিং স্টেজ থেকে জাম্প দিয়েছিলেন রেশমা। তারপর থেকে প্রায় ৪০০ ছবিতে তিন দশক ধরে অভিনয় করেছেন। হাজারেরও বেশী বিপজ্জনক দৃশ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন।

 তখন বিপদজনক দৃশ্যে কোনো বেসিক নিরাপত্তা ছিল না। ওপর থেকে ঝাঁপ দিতে গিয়ে নীচে পড়ে জখম হয়েছেন। সারা শরীরে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে শুটিং করেছেন। কেউ ফিরেও দেখেনি, প্রয়োজনই অনুভব করেনি কেউ। হাততালি কুড়িয়ে নিয়ে গেছেন স্টার নায়িকারা। রেশমা শুধু দেখে গেছেন। তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল বিখ্যাত 'শোলে' ছবিতে। মনে করুন শোলে ছবির সেই দৃশ্যটা, যেখানে গব্বর সিং এর দলবল ঘোড়ায় চড়ে হেমামালিনীর পিছনে ধাওয়া করেছে। 'চল ধন্নো! আজ তেরি বাসন্তী কি ইজ্জত কা সওয়াল হ্যায়'! হাওয়ার বেগে ছুটছে গাড়ি। খুলে গেছে একদিকের চাকা। তবু সেই খোঁড়া গাড়ি হারিয়ে দিচ্ছে দুর্ধর্ষ ভিলেনদের। এটুকু আমরা সবাই জানি। জানিনা শুধু সেই মেয়েটিকে যে এই দৃশ্যটিতে হেমামালিনীর বডি ডাবল হিসেবে অভিনয় করেছিল। সেদিন হেমামালিনীর বডি ডাবল হিসেবে ওই স্টান্ট করতে গিয়ে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন রেশমা। হ্যাঁ, শুটিং চলাকালীন পাথরে ধাক্কা খেয়ে গাড়িটি উড়ে গিয়ে পড়ে এবং তাঁর পা মারাত্মক জখম হয়, হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। ডাক্তার 'বেড রেস্ট'এ থাকতে বলেছিলেন। রমেশ সিপ্পি ধরেই নিয়েছিলেন দৃশ্যটি বাদ দেওয়া হবে। কিন্তু দৈন্য থেকে উঠে আসা, অল্পবয়সে জীবনযুদ্ধের সম্মুখীন হওয়া সেই মেয়ের কাছে 'রেস্ট' শব্দটি ছিল বিলাসিতা, যা তাঁর জীবনে ছিল না। বিশ্রামে থাকতে পারেনি রেশমা। দু দিনেই হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এসে খোঁড়া পায়ে সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্যটির শুটিং সম্পূর্ন করেছিলেন এবং একটি শটেই।

 

'কর্জ' সিনেমায় একটি দৃশ্যে দূর্গা খোটের বডি ডাবল হিসেবে ট্রাকের সামনে ঝাঁপ দেওয়ার কথা ছিল। পরিচালকের নির্দেশে ট্রাকটি তাঁকে দ্রুতবেগে ধাক্কা মারে। ক্যামেরা বন্ধ হয়নি। গুরুতর আহত হয়ে ছয় মাস হাসপাতালে থাকতে হয় তাঁকে। কেউ খোঁজ করেনি। ক্ষতিপূরণ তো নয়ই। মনের শক্তিতে উঠে দাঁড়িয়েছেন তিনি। শুটিং সেটে আপত্তিজনক আচরণ করায় একজন বিখ্যাত হিরোর সাথে কাজ করতে অস্বীকারও করেছেন। প্রথম দিকে জুনিয়ার আর্টিস্টের পয়সা মিলত, যার তীব্র প্রতিবাদ করেন রেশমা। 'গঙ্গা কি সৌগন্ধ' ছবির পরে অনেক লড়াই করে স্টান্টম্যান অ্যাসোশিয়েসনের কার্ড মেলে। তাঁর লড়াই ছিল সবার সাথে। সমাজ, ধর্ম, পুরুষ সহকর্মী, সুযোগসন্ধানী ফিল্ম জগৎ -সকলের সঙ্গে সবকিছুর সঙ্গে। কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। যুদ্ধ জারি রেখেছিলেন। দেখিয়ে দিয়েছেন সত্যিকারের নায়িকা হতে গেলে চেহারা নয়, দরকার সাহস আর ইতিহাস পালটে ফেলার ক্ষমতা।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...