যাত্রীবাহী বেলুন বা ‘হট এয়ার বেলুন’। জোসেফ ও স্টিফেন মন্টগলফিয়ার নামক দুই ফরাসি ১৭৮৩ সালে যুগান্তকারী এই বেলুন আবিষ্কার করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই এই বেলুন নিয়ে গোটা ইউরোপে এক অভূতপূর্ব উন্মাদনার সৃষ্টি হয়। দেশ ভেদে এই উন্মাদনার প্রকৃতি ছিল ভিন্ন। ফ্রান্সের বিজ্ঞানী মহল যখন এই নতুন আবিষ্কার নিয়ে নানাবিধ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত, তখন ব্রিটেনের বুদ্ধিজীবীদের এ ব্যাপারে কোনও মাথা ব্যথাই ছিল না। এডভেঞ্চারপ্রেমী-দুঃসাহসী ইংরেজরাই বরং বেলুনের প্রকৃত কদর করতে পেরেছিল। তারা দেশ-বিদেশ ঘুরে বেলুনে চড়ে হরেক রকম খেলা দেখিয়ে বেড়াতে থাকে। তাদেরই একজনের নাম পার্সিভাল জি স্পেন্সার। যিনি ১৮৮৯ সালে কলকাতায় আসেন 'বেলুনে চড়া' খেলা দেখাতে।
তখন ঊনবিংশ শতাব্দী, ইংরেজ শাসিত ভারত। গ্রীষ্মকালের এক বিকেলে কলকাতার নারকেলডাঙা মাঠে জমায়েত করেছে প্রায় ৮ হাজার মানুষ। সকলেরই চোখে মুখে উৎসুক ভাব আর সকলেরই দৃষ্টি মাঠের মাঝখানে রাখা এক সুবিশাল ফানুসের উপর। গ্যাস ভরা সেই ফানুসের নিচের দিকে লাগানো রয়েছে একটা ইস্পাতের আংটা, সেই আংটা থেকে প্রায় ১২ ফুট নিচে ঝুলছে বড়সড় এক ঝুড়ি। সেই ঝুড়িতে চড়েই সর্বপ্রথম 'হট এয়ার বেলুন' বা যাত্রীবাহী বেলুনের মাধ্যমে আকাশে উড়বেন এক বাঙালি।
সাদা রঙের জ্যাকেট আর বেগুনি ট্রাউজার পরিহিত গলায় দূরবীন ঝোলানো পুরাদস্তুর সাহেবি মেজাজে দর্শকদের মাঝে হাজির হলেন আকাঙ্ক্ষিত সেই বাঙালি। চড়ে বসলেন বেলুনের ঝুড়িতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুড়িসহ মানুষটি নিয়ে যাত্রীবাহী বেলুন শূন্যে উঠতে থাকে। যাত্রীবাহী বেলুন ওড়ানোর সাফল্যে জনসমুদ্রে তখন উল্লাসের জোয়ার। সেই প্রথম কোনো বাঙালি তথা ভারতীয় সর্বপ্রথম বেলুনের মাধ্যমে আকাশে উড়ে তৈরী করেন নতুন দৃষ্টান্ত। এই দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী, রোমাঞ্চপ্রেমী মানুষটিই হলেন রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
স্পেন্সার যখন কলকাতায় এসেছিলেন, সেসময়টা ছিল বাঙালির ‘ফিজিক্যাল কালচার মুভমেন্ট’- এর সূচনালগ্ন। ‘ভীরু-গোবেচারা’ তকমা ঘোচানোই ছিল এই মুভমেন্টের প্রধান উদ্দেশ্য। তাই বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠছিল শরীরচর্চার আখড়া। তরুণরাও দলে দলে যোগ দিতে থাকে সেসব আখড়ায়। এমত অবস্থায় স্পেন্সার রেসকোর্সের মাঠে ১৮৮৯ সালের ১৯ মার্চ প্রথমবার তার কেরামতি দেখান। অনেক যুবকই ইংরেজদের এই দুঃসাহসিক খেলায় তাদেরকে টক্কর দেবেন বলে পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। সেই যুবকদের মধ্যেই দুই যুবক ছিলেন- অবতার চন্দ্র লাহা ও অনিলচন্দ্র ব্যানার্জি।
অবতার চন্দ্র লাহা সরাসরি স্পেন্সারের কাছে 'বেলুনিং' শিখতে চান। অনিলচন্দ্র ব্যানার্জিও সমসাময়িক একটি পত্রিকায় স্পেন্সারের জ্ঞাতার্থে এক খোলা চিঠি লেখেন। দুর্ভাগ্যক্রমে এদের কারোর ইচ্ছেই পূরণ হয়নি। লাহা আর ব্যানার্জি কেউই স্পেন্সারের সহায়তা পাননি। পরবর্তিতে অবতার চন্দ্র লাহাই রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বেলুনিং এর প্রতি আকৃষ্ট করেন এবং স্পেন্সারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
কাঁসারিপাড়ার রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কর্মজীবন শুরু নব গোপাল মিত্রের ন্যাশনাল সার্কাসে ফ্লাইং ট্রাপিজ হিসেবে। পরবর্তীতে তিনি গ্রেট ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান সার্কাসের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া গভর্নমেন্ট নর্মাল স্কুলে শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন কিছুকাল।
সেসময়ে স্পেন্সারকে ৫০০ টাকা দক্ষিণা দিয়ে রামচন্দ্র বেলুনিং এর বিলিতি বিদ্যা রপ্ত করেন। 'স্পন্সর' হিসেবে পেয়ে যান পাথুরিয়াঘাটার জমিদার গোপাল চন্দ্র মুখার্জিকে। প্রথম শো- এর দিনও ঠিক হয়ে যায়। অবশেষে সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১০ এপ্রিল রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে বেলুন ওড়ে আকাশে। প্রথম উড়ানের দিন স্পেন্সারও ছিলেন তাঁর সঙ্গে। সেটিই ছিল কোনো ভারতীয়র প্রথম বেলুন বিহার। বেলুনটি নারকেলডাঙার ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানির মাঠ থেকে বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ যাত্রা শুরু করে প্রায় একঘন্টা শূণ্যে ভ্রমন করে বর্ধমান থেকে মাইল তিনেক দূরে একটি গ্রামে অবতরণ করে।
'বেলুনিং' খুবই ঝুঁকিপূর্ণ খেলা। যেকোনো ছোটখাটো ভুল আরোহীদের ঠেলে দিতে পারে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে। বিশেষ করে অবতরণের সময় বেলুনিস্টকে সব থেকে বেশি সতর্ক থাকতে হয়। তাছাড়া সঠিক জায়গা নির্বাচন করে অবতরণ করাটাও দুরূহ ব্যাপার। প্রথমবারের উড়ানে সাফল্য পাওয়ার পর রামচন্দ্র ২৭ এপ্রিল তাঁর একক প্রদর্শনী করবেন বলে ঘোষণা করেন। স্পেন্সারের 'দ্য ভাইসরয়' বেলুনটি কিনে তার নতুন নাম দেন 'দ্য সিটি অফ ক্যালকাটা'।
এরপর রামচন্দ্রকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য ও নেটিভ স্টেট থেকে তিনি আমন্ত্রণ পেতে লাগলেন। হয়ে উঠলেন ভারতের প্রথম পেশাদার 'বেলুনিস্ট'। তবে ২৭ জুন এলাহাবাদের খুশেরাবাগে তিনি যে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেন, তা তাঁর অন্য সব অর্জনকে ছাপিয়ে যায়। অপর্যাপ্ত গ্যাস অথবা ত্রুটিপূর্ণ গ্যাসের কারণে সেবার বেলুন আর ভাসেনি। তখন রামচন্দ্র স্যান্ডব্যাগ সমেত গোটা ঝুড়িটাকেই খুলে ফেলেন বেলুন থেকে। ইস্পাতের হুপটির ওপর বসেই দেখান তাঁর কারিশমা, প্রমাণ করেন তাঁর নিশ্ছিদ্র পেশাদারি দক্ষতা।
তখনকার দিনে প্যারাসুটের ব্যবহার এখনকার মতো ছিল না। বেলুনের এক পাশে একটি দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকতো প্যারাসুট। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত লোকেরাই কেবল জানতো এর ব্যবহার। এছাড়া আবার সব বেলুনে এই বিশেষ ব্যবস্থা থাকত না। যেমন ছিল না রামচন্দ্রের বেলুনেও।
১৮৮০ সালে ২২ মার্চ টিভোলি গার্ডেন্স থেকে ফের হাওয়ায় ভাসেন রামচন্দ্র। সেবার তাঁর বাহন ছিল স্পেন্সারের 'দ্য এম্প্রেস অফ ইন্ডিয়া'। ৩৫০০ ফুট উচ্চতা থেকে লাফ দিয়ে রামচন্দ্র ভারতীয়দের আরও গর্বিত করেন। সাক্ষী ছিলেন চৈনিক রাষ্ট্রদূত মহামহিম আম্বান, চিত্রকর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিক্ষাবিদ যোগীন্দ্রনাথ সরকার ও স্বয়ং স্পেন্সার সাহেব। সেদিন টিভোলি গার্ডেন্সে রামচন্দ্রকে একটি গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই অনুষ্ঠানে স্পেন্সার নিজে স্বীকার করেন যে, অন্য কেউই হয়তো জরুরী পরিস্থিতিতে রামচন্দ্রের মতো দক্ষতার সঙ্গে অবতরণ করতে পারতেন না।
পরবর্তীতে রামচন্দ্র প্যারাসুটের সুবিধাযুক্ত একটি নতুন বেলুন সংগ্রহ করেন এবং যথাক্রমে দিল্লি, রাওয়ালপিন্ডি, ইন্দোর, আগ্রা ও বেনারসে তার অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। একবার কোনো একটি নেটিভ স্টেটের পাহাড়ের ওপর প্যারাসুট ল্যান্ডিং করার সময় তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। সেখান থেকে তাঁকে জীবিত অবস্থায় কলকাতা আনা হলেও শেষরক্ষা হয়নি। গোপাল মুখার্জি'র বাগান বাড়িতে ১৮৯২ সালের ৯ আগস্ট এই ভারতের প্রথম পেশাদার 'বেলুনিস্ট' শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।