নিজেকে তিনি বলতেন ‘আইকোনোক্লাস্ট’। প্রথার প্রাচীর ভাঙাতেই তাঁর মুক্তি। এই মানুষটির হাত ধরেই রক্ষণশীলতার ঝরোখা ভেঙে আলো দেখেছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা।
তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র। জ্যোতিঠাকুর আর রবি ঠাকুরের ‘মেজদাদা’। ভারতের প্রথম আইপিএস। জ্ঞানদানন্দিনীর স্বামী।
প্রতিটি ভূমিকাতেই তিনি সফল পুরুষ। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
জোড়াসাঁকোর ধারের ঠাকুর বাড়িতে ১৮৪২ সালের ১ জুন সত্যেন্দ্রনাথের জন্ম হয়। তার ঠিক পাঁচ বছর পরেই দ্বারকানাথের মৃত্যু হয় বিদেশে। মাথার ওপর বিপুল দেনার চাপ সামলাতে খরচে লাগাম টানেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ঠাকুরবাড়ির অন্দর থেকে বাহির সর্বত্রই সেই ছাপ স্পষ্ট। তবে সত্যেন্দ্রনাথের জীবনের শুরুটা হয়েছিল ঠাকুর বাড়ির আর পাঁচটা শিশুর মতোই। পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী আরবী থেকে সংস্কৃত, কুস্তি থেকে সঙ্গীত সব কিছুই শিখতে হয়েছিল।
শুরু থেকেই তিনি সরস্বতীর আশীর্বাদ ধন্য। হিন্দু স্কুলের ছাত্র ছিলেন।
১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পরীক্ষা শুরু হল। ২৪৪ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১১৫ জন প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। পরবর্তী সময়ে ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সিতে। এখানে সহপাঠী কেশব চন্দ্র সেন। মুক্তমনা বন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও হল ভালই। ব্রাহ্ম আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছিলেন। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে মহর্ষির দুই প্রধান সহায়ক ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ আর কেশব।
ব্রাহ্ম পত্রিকা প্রকাশ থেকে শুরু করে সমাজের জন্য নতুন গান তৈরি সবেতেই তিনি প্রথম সারি।
সতেরো বছর বয়সে বাবার ইচ্ছেয় বিবাহ করলেন যশোরের মেয়ে আট বছরের জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে।
নব পরিনীতা স্ত্রী’কে শিক্ষায়-দীক্ষা- সাংস্কৃতিক বোধে গড়ে তোলায় নজর দিয়েছিলেন। জ্ঞানদানন্দিনীর আগ্রহে তাঁর উৎসাহ বিফলে যায়নি।
তবে তিনি শুরু থেকেই জোড়াসাঁকোর অন্দরমহলের কাছের মানুষ ছিলেন। দিদি, বোন সকলেরই কাছের মানুষ। চাইতেন অন্দরে হাজার এক বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে থাকা মানুষদের মনে মুক্ত ভাবনার আলো- হাওয়া এসে লাগুক।
১৮৬২ সালে বন্ধু মনমোহন ঘোষের সঙ্গে বিলেত গেলেন। কঠোর পরিশ্রমে সিভিল সার্ভিস পাশও করলেন। নির্বাচিত ৫০ জন ছাত্রের মধ্যে তিনি ৪৩তম, শেষ পরীক্ষায় ষষ্ঠ।
তিনিই হলেন প্রথম দেশি সিভিলিয়ান। ১৮৬৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথের জাহাজ বঙ্গোপসাগরে ভিড়তেই কলকাতায় শুরু হয়ে গেল সংবর্ধনার আয়োজন । বেলগাছিয়ার বাগানে বিদ্যাসাগরের উপস্থিতিতে তাঁকে সংবর্ধিত করা হল। শুভেচ্ছা জানিয়ে সনেট লিখলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ।
প্রথম ভারতীয় সেশন জজ হয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। কিন্তু সরকারী চাকুরে হয়েও হারিয়ে যাননি সৃষ্টিশীলতার পথ থেকে। যখনই সময় পেয়েছেন লিখনীতে নিবিষ্ট রেখেছেন নিজেকে। গান বাঁধার পারদর্শিতা, ব্রহ্মনাদ প্রচার, শেক্সপিয়র-তুকারাম-কালিদাস অনুবাদ সাহিত্য সৃষ্টির পারিবারিক ধারা থেকে বিচ্যুত হননি কোনভাবেই।
রবীন্দ্রনাথের ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় দস্যুদলের নাচে কাবুলি ঢং এবং ডাকাতদের সাজসজ্জা তাঁরই নির্মাণ। ষাট বছর বয়সে ‘জুলিয়াস সীজার’ নাটকে মার্ক অ্যান্টনির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। মুগ্ধ হয়েছিল দর্শক।
শিল্প-সাহিত্য-মেধায় পারিবারিক ঐতিহ্যের ভাষায় কথা বলে উঠেছিল তাঁর জীবন। কিন্তু ঠাকুর বাড়ির অচলায়তনকে তিনি যেভাবে ভেঙেছেন সেভাবে আর কাউকে ভাঙতে দেখা যায়নি প্রকাশ্যে।
জ্ঞানদানন্দিনীকে অন্দরের কূলবধূর আড় ভেঙে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিতি করানো সহজ ছিল না। শুধু মাত্র বই-পুঁথির শিক্ষা নয়, পোশাকে, আচারে বহির্বিশ্বের উপযুক্ত করে তুলেছিলেন নিরন্তর চেষ্টায়। তার জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছিল ঘরে বাইরে। মহর্ষিও ভাল ভাবে নেননি জ্ঞানদানন্দিনী এবং সত্যেন্দ্রনাথের আচরণ।
সত্যেন্দ্রনাথ জ্ঞানদানন্দিনীর জন্য ‘ওরিয়েন্টাল’ পোশাক বানিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে বোম্বাইতে দিয়ে এক পারসি পরিবারের সংস্পর্শে এসে ‘বোম্বাই’ কায়দায় শাড়ি পড়া শেখেন।
সত্যেন্দ্রনাথকে চাকরি সূত্রে বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরতে হয়েছিল। সঙ্গে নিয়েছিলেন পরিবারকেও। ঠাকুরবাড়ির পরিসর থেকে বেরিয়ে একা মহিলার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ২ নাবালক সন্তানকে নিয়ে জাহাজে করে বিলেত যাওয়া ভাবনার বাইরে ছিল। কিন্তু এই সাহস আর জোর দেখানো সম্ভব হয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথের জন্য।
ব্যক্তিগত জীবনে একের পর এক প্রথা ভেঙেছেন। ইংরেজ রাজের চাকরী করেও বজায় রেখেছিলেন স্বাধীন সত্ত্বা। ইংরেজ রাজপুরুষরা খুব ভাল চোখে দেখেননি এই ‘বাঙালি বাবু’টিকে।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সরাসরি জড়িয়ে ছিলেন। হিন্দুমেলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘ মিলে সবে ভারত সন্তান’ একতি গান রচনা করেছিলেন। যে গানকে ভারতের প্রথম জাতীয় সঙ্গীত ভাবা হয়েছিল এক সময়। কন্যা ইন্দিরা দেবীর সঙ্গে মিলে মহর্ষির আত্মজীবনী ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন।
বহু মাত্রিক কর্ম কান্ডে ব্যপ্ত ছিল জীবন। এক সময় ঠাকুর বাড়ি ছেড়েছিলেন। পার্ক স্ট্রিটে আলাদা বাড়ি বানিয়ে সপরিবারে থাকতেন। রবি ঠাকুর, জ্যোতি ঠাকুরের কাছে আলাদা আকর্ষণ ছিল মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের বাড়িটি।
স্ত্রী স্বাধীনতার জন্য তাঁর সারাজীবনের সংগ্রাম বৃথা যায়নি। জীবনের প্রান্ত সীমায় পৌঁছে সেই তৃপ্তি তাঁর ছিল। নিজের লেখনীতে প্রকাশ করেছিলেন। সহোদরা স্বর্ণকুমারী দেবী লিখেছেন, ‘স্ত্রীজাতির উন্নতিতে ইনি এমনই অটলসংকল্প ছিলেন ...কোন বাধাকেই বাধা জ্ঞান করেন নাই, কোন অপমানেই তাঁহাকে নত করতে পারে নাই।’
১৯২৩- এর ৯ জানুয়ারী ৮১ বছর বয়সে মৃত্যু হয় ঠাকুর বাড়ীর অন্যতম আধুনিক পুরুষের।