ঘাড় পর্যন্ত চুল, সালোয়ার- কুর্তি দোপাট্টায় সজ্জিত এমন মেয়েকে হামেশাই দেখা যায় পথে-ঘাটে-রাস্তায়। ভিড়ে মিশে থাকা চেহারায় আলাদা করে নজরে পড়ার মতো কিছুই নেই। সে শুধু যুদ্ধ করতে শিখেছে।
কঠোর মুখ। কঠিন চোখ। দৃপ্ত শরীরী ভাষায় লক্ষ্যভেদী দৃষ্টি।। বাঘের পিঠে বাঘিনীর মতো একরোখা এক শ্যামাঙ্গী। হাতে কোনও অস্ত্র নেই। ভয় তাকে স্পর্শ করতে পারে না। সে লড়াই করে। উদ্ধার করে আনে দুর্বিপাকে পড়া মেয়েদের। কখনও যৌনপল্লী থেকে কখনও বা সমাজের বদ্ধ প্রাচীর ভেঙে। অ্যাসিড হামলায় বিক্ষত মেয়েদের হয়ে স্বর তোলে । কখনও বা ধর্ষিতার সামাজিক নিপীড়ন নিয়ে সোচ্চার। নাম তার প্রিয়া। নিজে গণধর্ষণের শিকার, তবু অকুতভয় প্রিয়া বাকিদের বার্তা দেয়, ‘ ভয়ের মুখোমুখি হও’। রক্তে, ঘামে, অসির ঝংকারে ‘বীর্যবতী রমণী’।
প্রিয়াকে প্রথম দেখা গিয়েছিল ২০১৪ সালে। তার ঠিক দু’বছর আগেই দিল্লিতে ‘নির্ভয়া’ ধর্ষণ কান্ড ঘটে। প্রথম দুই সংস্করণের পর আবার সে ফিরে এসেছে।
ভারতের প্রথম ‘ ফিমেল সুপার হিরো’। ‘প্রিয়া শক্তি’।
প্রথম সংস্করণে ‘প্রিয়া শক্তি’কে দেখা গিয়েছিল বাঘের পিঠে চড়ে পাঠকদের সামনে এসেছিল। ধর্ষণ এবং ধর্ষণ নিয়ে মানুষের যে ট্যাবু , প্রচলিত ধ্যান ধারণা তার বিরুদ্ধে প্রচারের অংশ হিসেবে এই কমিক চরিত্রটিকে সৃষ্টি করা হয়।
পরবর্তী সংস্করণে প্রিয়াকে দেখা যায় অ্যাসিডে হামলায় আক্রান্তদের সঙ্গে।
সাম্প্রতিক সংস্করণে প্রিয়া এবার পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের রক্ষাকর্তীর ভূমিকায়। রাহু নামে এক পাচারকারীর বিরুদ্ধে লড়াই চালায় সে। রাহু বহু মেয়েদের যৌনপল্লীতে বিক্রি করে করে দিয়েছে। তাদের মধ্যে প্রিয়ার বোনও আছে।
শুরুতেই দেখা যায়, মূল প্রোটাগনিস্ট নিজের গ্রামে এসেছে। দেখে গ্রামে কোনও মেয়ে নেই। সেখান থেকেই কাহিনির শুরু।
রহস্য উদঘাটনের জন্য প্রিয়া সঙ্গী মাউন্টেন টাইগার ‘সাহস’ কে নিয়ে রাহুর গুহায় হানা দেয়। রাহুর মুখোমুখী হয়ে প্রিয়াকে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। এমন তাকেও পাচার চক্রে জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু বাধা বিপত্তি কাটিয়ে জয় হয় শুভ’র। প্রিয়া লক্ষ্মী এবং আটক থাকা অন্যান্য মহিলা দের উদ্ধার করে আনে।
কিন্তু সেখানেই লড়াইটা শেষ হয়ে যায় না। যৌনপল্লী থেকে উদ্ধার হওয়া মেয়েদের বাড়ির লোক আর ফিরিয়ে নিতে চায় না। তাদের ব্রাত্য করে রাখা হয় সমাজের দোহাই দিয়ে।
প্রিয়া আর বাকি মেয়েরা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এই গল্পই কমিকসের রূপ পেয়েছে, ‘প্রিয়া অ্যান্ড দ্য লস্ট গার্ল’।
ইন্দো-আমেরিকান অভিনেত্রী লেখক দীপ্তি মেহতা কমিকসের স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনীর আদলেই চরিত্রটিকে তৈরি করা হয়েছে।
প্রথম ভারতীয় ফিমেল সুপার হিরো সম্পর্কে বলতে গিয়ে দীপ্তি মেহেতা বলেন, ‘ ২০১৭ এ হলিউডে যেভাবে মি-টু নিয়ে মেয়েরা মুখ খুলেছিল। সামনে এনে নিজেদের নিগ্রহের কাহিনী, প্রতিবাদে মুখর হয়েছিল, ঠিক সেই লক্ষেই গড়ে তোলা হয়েছে প্রিয়াকে।
কমিকসটি যাঁর মস্তিষ্ক প্রসূত সেই রাম দিভাইনেনি বলেন, কমিকসের পরিকল্পনা মাথায় আসার পর তিনি বেশ কিছু যৌনপল্লী ঘুরে দেখেন। এশিয়ার সবচেয়ে বড় যৌন পল্লী কলকাতার সোনাগাছিতেও আসেন। সাধারণ যৌন কর্মীদের বেঁচে থাকা, জীবন সামনে থেকে পর্যবেক্ষণ করেন।
কমিকস রূপ দিয়েছেন চিত্রশিল্পী সৈয়দ ফিনি।
বিভিন্ন মানবাধিকার এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মতে সারা বিশ্বে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষ কোন না কোনও ভাবে পাচার চক্রের ফাঁদে পড়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। ভারত, নেপাল, বাংলাদেশে সর্বাধিক। ভারতে সংখ্যাটা ২৭ হাজার।
‘প্রিয়া শক্তি’ সাড়া ফেলেছে মানুষের মধ্যে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। যাতে মানুষের কাছে সহজে পৌঁছায় তার জন্য প্রকাশিত হওয়ার পরেই ফ্রি- ডাউনলোডের সুযোগ করে দেওয়া হয়।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং মানবাধিকার কর্মী রুচিরা গুপ্তার সহায়তায় পুরো ভাবনাটি বাস্তবে রূপ পায়। রুচিরা গুপ্তা জানিয়েছেন এই কমিকস বুক আসলে কমিকসের আড়ালে খুব জরুরি কিছু পাঠ শেখায়। যা প্রতিটি সচেতন নাগরিকের যা জেনে রাখা জরুরি। ভারত এবং বিদেশের স্কুল, কলেজগুলোতে ছাত্রছাত্রঈদের মধ্যে কমিকসকে পৌঁছে দিতে চান তাঁরা।