কীসের টানে- অমৃত কুম্ভের সন্ধানে!
ঈশ্বরের বাস মনে না ইট-কাঠ-পাথরের চার দেওয়ালে?সংস্কার কি কুসংস্কারের উল্টো পিঠ?
কারও ধুলো মাখা খালি পা;কেউ ছেঁড়া চটি ঠিক করে নিচ্ছে নিচু হয়ে;কারও পা ফেটেছে অসহনীয় শীতের দাপটে;কারও রক্ত ঝড়ছে; কারও গায়ে এক ছিটে কাপড়; কারও কোলে সদ্যোজাত;কেউ ভিড়ে হারিয়েছে আপনজনকে- তাই পিছন ফিরে মাঝে মাঝেই দেখে নিচ্ছে একবার।
কেউ এসেছেন রাজস্থানের বা হরিয়ানার কোন শেষ প্রান্ত থেকে যেখানে রাতে গা ঢাকার জন্য চাদর মেলা দায়; কারও পেটে খাওয়ার পড়েনি ২ দিন; কেউ বাড়িতে রেখে এসেছেন অসুস্থ বুড়ি মা-কে।উদ্যেশ্য, সাগরের জলকে একবার ছুঁয়ে দেখা; যেন ঈশ্বরের পা ধোয়া জল।
এই ছবি সকলেরই পরিচিত। পৌষের সাগর মেলা।যদিও দর্শনার্থীদের জন্য চোখ তুলে তাকিয়েছেন প্রশাসন।প্রযুক্তি ও সুরক্ষার জোড় মেলবন্ধনে কষ্টের কিছুটা লাঘব করা সম্ভব হয়েছে।
সব তীর্থ বারবার গঙ্গা সাগর একবার
কিংবদন্তি বলে, সাংখ্যদর্শনের আদি-প্রবক্তা কপিলমুনির ক্রোধাগ্নিতে সগর রাজার ষাট হাজার পুত্র ভস্মীভূত হন এবং তাদের আত্মা নরকে নিক্ষিপ্ত হয়। সগরের পৌত্র ভগীরথ স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে নিয়ে এসে সগরপুত্রদের ভস্মাবশেষ ধুয়ে ফেলেন এবং তাদের আত্মাকে মুক্ত করে দেন (রামায়ণ, বালকাণ্ড, ৪৩ অধ্যায়)। মহাভারতের বনপর্বে তীর্থযাত্রা অংশে গঙ্গাসাগর তীর্থের কথা বলা হয়েছে। পালবংশের রাজা দেবপালের একটি লিপিতে তার গঙ্গাসাগর-সঙ্গমে ধর্মানুষ্ঠান করার কথা বলা হয়েছে।
লোক-কাহিনী অনুযায়ী এখানে কপিল মুনির একটি আশ্রম ছিল। একসময় সেটি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে আশ্রমটিকে কেন্দ্র করে তার ভক্তদের সমাগম বাড়তে থাকে। প্রত্যেক বছর জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি মকরসংক্রান্তি বা পৌষ-সংক্রান্তির পূণ্যতীথিতে লাখো লাখো লোকের সমাগম ঘটে এই সঙ্গমে। এই সমাগমকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিরাট মেলা যার নাম গঙ্গাসাগর-মেলা। ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলা। কুম্ভের পরেই।
বিশ্বাসের আরও একটি গল্প প্রচলিত। সমুদ্র মন্থনের সময় উঠে আসা অমৃত থেকে ৩ ফোঁটা সুধা মকর সংক্রান্তির দিনেই গঙ্গা বক্ষে এসে পড়েছিল।তাই এই দিনে সেই জলে স্নান করার অর্থ অমর হওয়ার ধারনারও জন্ম দেয়।
মকর সংক্রান্তির পূণ্য তিথি।সাগর মেলায় সাগর আর লক্ষ মানুষের ভিড় একাকার। ফি বছরই মেলার জনসমুদ্র বিগত বছরের রেকর্ড কে ছাপিয়ে যায়।সরকারি হিসাবে গত বছর সাগর মেলায় প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়েছিল।
পৌষের হাড় হিম করা ঠাণ্ডাকে উপেক্ষা করে , অনেক দূরের পথ পেরোবার জন্য মানুষ পা বাড়িয়েছে। সেই মিছিলে পা মিলিয়েছে গ্রাম থেকে শহরের অগুনতি আরও মানুষ।
মেলা মিলনের আরেক নাম। কিন্তু এই মেলায় সকলে ঈশ্বরের খোঁজ পান আর না পান, এটা জানেন যে এসেছেন মানে তো কিছু হারাতেই হবে। এই হারানোর তালিকায় কোন জিনিস নয় মানুষের সংখ্যাই বেশি।তাদের বিশ্বাস যেন স্বয়ং ভগবানই তাদের ডেকে নিয়েছেন।
বলা হয়, কোনো কিছু ভীষণ ভাবে মন থেকে চাইলে, সেটা পাওয়া যায়। তাহলে এই কোটি কোটি মানুষের চাওয়া কি পাওয়াতে বদলায়? তারা যে শুন্য ঝুলি হাতে ঘর থেকে বেরোন সেখানে কষ্ট অজান্তেই জায়গা করে নেয়। শুধু দেশ নয়, সীমানা পেরিয়ে দেশান্তরের ঠিকানাও হয়ে ওঠে এই মেলা।
এই দীর্ঘ যাত্রায় রাস্তাই তাদের ঠিকানা,ফুটপাথ বিছানা আর ঈশ্বর কে খুঁজে পাওয়ার ভক্তি বালিশ। শহুরে আলো-বাতাস খেয়াল করে না এদের না দেখা অদম্য বিশ্বাস।বিশ্বাসে ভর করেই কল্পনার ঈশ্বরকে ছুঁতে চাওয়ার সাধ।রোজের জীবনে অনেক ভুল, অনেক ক্ষমা অযোগ্য ঘটনা সকলেই লেখে মনের পাতায়।প্রত্যেকেই আবার নিস্তার পেতে চান সেই ভুলের গণ্ডি থেকে। কে দেবে নিস্তার? কে দেবে আস্থা এগিয়ে যাওওার?পাতায় লেখা শব্দরা অর্থ হারালে, অলৌকিকতাই হয়ে ওঠে জীবন এগিয়ে নেওওার একমাত্র উপায়।
বাস্তবে যা কিছু পাওয়া হয়ে ওঠে না,সেটাই চাওয়া হয় ওই ঈশ্বরের কাছে।এই জীবনে না হলেও পরের জীবনে সেই অপূর্ণতার ভাড়ার নিশ্চয় পূর্ণ হবে।তবে যা কিছু প্রাপ্তি তা কি সেই কষ্ট কেও ছাপিয়ে যেতে পারে?আসলে শরীর আর মনের এই মিলন ব্যাতিরেকেই ঈশ্বরের অবস্থান।ঈশ্বর কে পেতে গেলে তাই বোধ হয় চোখ বুজে আসে।