"১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি যখন আসফকে বিয়ে করি তখন আমার পিতা জীবিত ছিলেন না। আমার কাকা নগেন্দ্র নাথ গাঙ্গুলি, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, তিনি নিজেকে আমার অভিভাবক বলে আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের কাছে পরিচয় দিতেন। তিনি বিয়ে করায় আমাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন এবং শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেন"।
অরুণা আসফ আলি স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে এই কথাগুলো লিখে গেছেন। কাকা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলির মনোভাব নিয়ে তাঁর এই খেদোক্তি। সেই সময় তাঁর পরিবার ব্রাহ্ম পরিবার হিসেবে আধুনিকতায় এবং শিক্ষায় এগিয়ে থাকা একটি পরিবার। তাঁর কাকা নগেন্দ্র নাথ গাঙ্গুলি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন না, তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ কন্যা মীরাদেবীর স্বামী। পিতা উপেন্দ্র নাথ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন ব্রাহ্মধর্মের পরিচিত মুখ। মা অম্বালিকা দেবীর পিতা ত্রৈলোক্য নাথ সান্যাল ছিলেন ব্রাহ্ম সঙ্গীতের রচয়িতা।
তাঁর আরেক কাকা ধীরেন্দ্র নাথ গঙ্গোপাধ্যায় "পদ্মশ্রী" এবং "দাদাসাহেব ফালকে" পুরস্কার প্রাপ্ত অভিনেতা ও পরিচালক। তিনি "বম্বে টকিজের" চলচিত্র পরিচালকও ছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়াকে বিবাহ করেছিলেন। এহেন বনেদি পরিবারের মেয়ে হয়ে মাত্র ১৯ বছর বয়সে তাঁর থেকে ২২ বছরের বড়ো এবং পৃথক জাতির একজনকে বিবাহ করার অপরাধে পরিবারের বিরাগভাজন হতে হয়েছিল। তাতে এই অগ্নিকন্যা দমে যান নি। পরবর্তীকালে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন বলিষ্ট যোদ্ধা হয়ে ওঠেন।
পাঞ্জাবের কালকায় জন্ম। পড়াশোনা লাহোরের স্যাক্রেড হার্ট কনভেন্ট স্কুলে। নৈনিতালের অল সেন্টস মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক। অরুণা কলকাতার গোখেল মেমোরিয়াল বিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতার কাজেও যুক্ত ছিলেন। এলাহাবাদে, ব্যারিষ্টার তথা কংগ্রেস নেতা আসফ আলির সঙ্গে আলাপ হয় অরুণা গঙ্গোপাধ্যায়ের। আলাপ ধীরে ধীরে প্রেমে পরিণত হলে তাঁরা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। আসফ আলির হাত ধরেই অরুণার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে।
বিয়ের পরেই অরুণা আসফ আলি জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এই সময় তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর স্বামী আসফ আলিও সেই সময় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী বটুকেশ্বর দত্ত এবং ভগৎ সিংয়ের হয়ে মামলা লড়ছেন। স্বামী-স্ত্রী দু'জনেই স্বদেশীর কাজে নিজেদের ডুবিয়ে দিয়েছিলেন।
"লবণ সত্যাগ্রহ"-এর সময় ব্রিটিশ সরকার অরুণা আসফ আলিকে ভবঘুরে তকমা দিয়ে কারারুদ্ধ করে। ১৯৩১ সালে "গান্ধী-আরউইন" চুক্তির সময় রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হলেও অরুণা আসফ আলিকে মুক্তি দেওয়া হয় না। ১৯৩২ সালে তাঁকে তিহার জেলে পাঠানো হয়। সেখানে রাজনৈতিক বন্দীদের প্রতি উদাসীন আচরণ দেখে তিনি অনশন শুরু করেন। তাঁর এই প্রতিবাদে তিহার জেলের কর্তৃপক্ষ নড়ে চড়ে বসে। অরুণা আসফ আলির প্রতিবাদ অনশনে জেলের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। তবে তাঁকে আম্বালার নির্জন কারাবাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শেষে মহাত্মা গান্ধী হস্তক্ষেপে তিনি মুক্তি পান।
বিয়াল্লিশের " ভারত ছাড়ো আন্দোলন"-এ তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ৯ আগস্ট বোম্বাই গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানে ইউনিয়ন জেক নামিয়ে দেশের ত্রিরঙা পতাকা নির্ভয়ে উড়িয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে নানা কারণে জাতীয় কংগ্রেস ছেড়ে সোসালিষ্ট দলে যোগ । দিল্লীর প্রথম মহিলা মেয়র হিসেবে তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় খোদিত হয়ে থাকবে।
স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। জাতীয় কংগ্রেসের পত্রিকা "ইনকিলাব"- এর সম্পাদক ছিলেন। ইংরেজি দৈনিক " প্যাট্রিয়ট" পত্রিকায় নিয়মিত "কলাম" লিখতেন। এছাড়া নিজের স্বাধীনতা বোধ প্রচুর সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে "লিঙ্ক" নামের একটি সাময়িক পত্রিকা শুরু করেছিলেন।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যেক'জন অগ্নিকন্যা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অরুণা আসফ আলির নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।