তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তৈরি হয়েছে ডামাডোল পরিস্থিতি। কলকাতার কৃতীসন্তান প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ বিলেতের পাঠ শেষ করে দেশে ফিরবার প্রস্তুতি নিয়েও এই অবস্থায় যাত্রা স্থগিত রাখতে বাধ্য হলেন। ভাগ্যিস বাধ্য হলেন, না-হলে হয়তো যোগাযোগটাই হত না। কেননা, ‘আসল কথা হল যোগাযোগ’। হ্যাঁ, তা থেকেই ক্রমে তৈরি হল ইতিহাস।
আসলে, বিলেতে তিনি কিংস কলেজে পড়তেন। আপৎকালীন অফুরন্ত সময় কাটাতে তিনি সেই কলেজের লাইব্রেরিতেই আশ্রয় নিলেন। নিত্য যাতায়াতের মধ্যে একদিন শিক্ষক মেকলের সঙ্গে তাঁর সেখানেই সাক্ষাৎ হল। একথা-সেকথার মধ্যে মেকলে তাঁকে লাইব্রেরির তাকে থাকা রাশিবিজ্ঞানের ওপর অধ্যাপক কার্ল পিয়ারসন সম্পাদিত কয়েক খণ্ডের ‘বায়োমেট্রিকা’ বইটি দেখিয়ে উপদেশ দিলেন, ‘পড়ে দেখো!’। রাশিবিজ্ঞানে প্রশান্তচন্দ্র’র খুব আগ্রহ। তাই মেকলে চলে যেতেই বইটি নিয়ে পড়তে শুরু করে দিলেন। বইটি দারুণ আকৃষ্ট করল। সেই সঙ্গে রাশিবিজ্ঞানের প্রভূত সম্ভাবনার দিকগুলোও তাঁর সামনে হাট করে খুলে দিল। এখান থেকেই প্রশান্তচন্দ্র রাশিবিজ্ঞানের ওপর বিস্তৃত পাঠ ও গবেষণা শুরু করে দিলেন।
ভারতবর্ষে তখনও রাশিবিজ্ঞান সম্পর্কে শিক্ষিতমহলের তেমন কোন ধারণাই ছিল না। প্রশান্তচন্দ্র ঠিক করলেন যে, দেশে ফিরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে রাশিবিজ্ঞান পঠনপাঠনের ব্যবস্থা তো করবেনই, সেই সঙ্গে তাকে জাতীয়জীবনে কাজে লাগানোর ব্যবস্থাও তিনি করবেন। ১৯১৫ সালে দেশে ফিরলেন। তারপরই শুরু হল তাঁর কাজ।
রাশিবিজ্ঞানের সাহায্যে প্রভূত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে পরিসংখ্যান তৈরি করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। এই রূপরেখার ওপর ভিত্তি করেই শ্রদ্ধেয় ব্রজেন শীলের অনুরোধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা-ব্যবস্থার সংস্কারে সহায়তা করেন প্রশান্তচন্দ্র। শুধুমাত্র রাশিবিজ্ঞানের সহায়তায় অর্থনীতিবিদ না-হয়েও নেহেরুর অনুরোধে তিনি দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সার্থক খসড়া তৈরি করে দেন। কলকাতার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান নির্ণয় করে সমাজবিজ্ঞানেও অবদান রাখেন। আবহাওয়াবিদ্যাতেও যুগান্তকারী অবদান রাখেন তিনি। রাশিবিজ্ঞানের সাহায্যে বলেন, আমরা যে আবহমণ্ডলের মধ্যে বাস করি, তার বিস্তার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ওপরের দিকে চার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। ভৌতবিজ্ঞানীরা এই একই সিদ্ধান্তে আসেন আরও কয়েক বছর পর। রাশিবিজ্ঞানে ভিত্তি করে হিরাকুঁদ বাঁধ তৈরির তিরিশ বছর আগেই নদীর নাব্যতা ও বেগ নির্ণয় করে ঘোষণা করেন যে, এখানে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা মানুষের কাজে লাগানো সম্ভব। এভাবেই দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের নিরলস সাধনায় তিনি রাশিবিজ্ঞানকে জাতীয়জীবনের বহুধা প্রয়োজনের শরিক করে দিতে সক্ষম হন। সক্ষম হন ভারতবর্ষে রাশিবিজ্ঞানকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য করে তুলতে।
প্রশান্তচন্দ্রের সবচেয়ে বড় অবদান ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট’। বি টি রোডের ওপর বরানগরে এই প্রতিষ্ঠান অবস্থিত। ‘আই এস আই’ বাসস্টপ হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানের সম্মুখ-দরজা সকলের পরিচিত। এই প্রতিষ্ঠান শুধু কলকাতার গর্ব নয়, সারা ভারতের গর্ব। সারা বিশ্বের রাশিবিজ্ঞানচর্চার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম এটি। প্রতিষ্ঠানটি সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের পদধূলিধন্য।
রাশিবিজ্ঞানের জন্য দেশ-বিদেশের প্রভূত সম্মান অর্জনের পাশাপাশি ভারতে প্রথম কম্পিউটার আনার কৃতিত্বও রয়েছে প্রশান্তচন্দ্রের ঝুলিতে। এতে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন আর এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী, হোমি জাহাঙ্গির ভাবা। ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট’ ভারতের প্রথম প্রতিষ্ঠান, যেখানে এই দু’জনের প্রচেষ্টায় প্রথম আধুনিক গণকযন্ত্র অর্থাৎ কম্পিউটারের আগমন ঘটে। এটা বঙ্গবাসীর কাছে অনেক বড় গৌরবের কথা। ঘটনাটি স্পষ্ট করে যে, প্রশান্তচন্দ্র আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে কতটা উদার, কতটা সমকালীন ছিলেন।
শুধু রাশিবিজ্ঞানকে সমাজের বিভিন্ন বিদ্যাচর্চার সঙ্গে যুক্ত করেই প্রশান্তচন্দ্র ক্ষান্ত থাকেননি। রেখেছেন বাংলাভাষা ও সাহিত্যপ্রীতির পরিচয়ও।
রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন প্রশান্তচন্দ্র। তাঁর সাহিত্যরুচির ওপর আস্থা রেখেই রবীন্দ্রনাথ নিজের বাছাই কবিতার প্রথম সংকলন ‘চয়নিকা’র জন্য কবিতা নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রশান্তচন্দ্রকে। প্রশান্তচন্দ্রও সেই কাজ অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছিলেন। বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা জন্যই এটা সম্ভব হয়েছিল। আর এই ভালোবাসা থেকেই তিনি ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিতিউট’-এর মুখপত্র প্রকাশ করতেন বাংলায়, যার নাম দিয়েছিলেন, ‘সংখ্যা’।
সাহিত্যিক সুকুমার রায়ের সঙ্গে প্রশান্তচন্দ্রের ছিল দারুণ সখ্য। সুকুমারের অকালমৃত্যুতে তিনি অত্যন্ত আঘাত পেয়েছিলেন। সারাজীবন তাঁর পরিবারের সঙ্গে জুড়ে ছিলেন শুভানুধ্যায়ী হয়ে। সেই শুভাকাঙ্ক্ষা থেকেই যুবক সত্যজিৎ রায়কে স্ট্যাটিস্টিকসে স্নাতক করে ‘সংখ্যা’ পত্রিকায় চাকরি দিয়ে পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। তাঁকে আনতে চেয়েছিলেন রাশিবিজ্ঞানের জগতে। সত্যজিৎ যদিও তাঁর ইচ্ছেয় স্নাতক হয়েছিলেন, কিন্তু এই বিষয়ে এগোতে আর আগ্রহী হননি। কেননা, স্ট্যাটিস্টিকস তাঁর ভালো লাগেনি।
এভাবেই বন্ধুকৃত্যে, সমাজক্ষেত্রে, রাশিবিজ্ঞানে নিজের অকুণ্ঠ অবদান রেখে প্রশান্তচন্দ্র আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন; কিন্তু তাঁর কৃতিত্বের সাক্ষী হয়ে বিশ্বের দরবারে কলকাতার গর্ব হয়ে আজও পাণ্ডিত্য, প্রগতি আর পরিসংখ্যানের আকর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট’…