বিজ্ঞানের মঞ্চে অনস্বীকার্য অবদানের জন্য আজও চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন কেএস কৃষ্ণন। স্বাধীনতার এক বছর পর, ১৯৪৮ সালে ভারতের প্রথম ন্যাশনাল ফিজিকাল ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়। ল্যাবরেটরি স্থাপন হলেও দক্ষ হাতে তার পরিচালনার জন্য যথাযথ পরিচালক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠছিল। ঠিক সেই সময়, বিজ্ঞানের জগতে অভূতপূর্ব অবদান থাকার কারণে ডাক পড়ে বিশিষ্ট পদার্থবিদ কৃষ্ণনের। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ল্যাবটি পরিচালনার সমস্ত ভার প্রদান করেন তাঁকে।
বিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যায় দেশের উন্নতি সাধনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল এই ল্যাবরেটরি। ল্যাব স্থাপনের পরবর্তী কালে দেশের অসংখ্য মেধাবী ছাত্র এই ল্যাবে গবেষণা করেন এবং পদার্থবিদ্যায় ভারতের অবদানগুলিকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যেতে সাক্ষ্য প্রদান করেন। এই ল্যাবের রিসার্চড আর্টিকেল থেকে উদ্ধৃতি সংগ্রহ করে থাকেন আন্তর্জাতিক পদার্থবিদেরা। ডিএসটি লকহীড মার্টিন ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড সহ অসংখ্য সন্মানের অধিকারী এই ল্যাব।
কৃষ্ণন সম্বন্ধে একটি বিবৃতিতে নেহেরু বলেছিলেন, “কৃষ্ণনের সবচেয়ে বড় পরিচয় এই নয় যে তিনি বিজ্ঞানী, বরং তার চাইতেও বেশি কিছু। উনি একজন যথাযথ নাগরিক, একীভূত ব্যক্তিত্ত্ব সহ একজন পরিপূর্ণ মানূষ।“
১৮৯৮ সালে, তামিলনাড়ুর ওয়াত্রাপ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কৃষ্ণন। বাবা ছিলেন একইসাথে পণ্ডিত ও চাষি। তাঁর গ্রথিত শিক্ষাতে ছেলেবেলা থেকেই শিক্ষার প্রতি এক গভীর ও অনন্য আকর্ষণ অনুভব করতেন কৃষ্ণন। নবম শ্রেণীতে পাঠরত অবস্থায় বিজ্ঞানের প্রতি প্রেম প্রথমবারের জন্য চোখে পড়ে, এই প্রতিভা অর্জনের জন্য প্রায়ই তিনি তাঁর শিক্ষকের অবদানের কথা উল্লেখ করতেন।
“পেশাদার বিজ্ঞানী না হওয়া সত্ত্বেও এক চিত্তাকর্ষক কায়দায় বিষয়টি তিনি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতেন। আমাদের মস্তিষ্ক তাঁর প্রণোদিত শিক্ষাকে গভীরভাবে শুষে নেওয়ার পাশাপাশি বিজ্ঞানের প্রতি আরও খিদে বাড়িয়ে দিত। পদার্থবিদ্যা, ভুগোল, রসায়নবিদ্যা-যাই হোক না কেন, তাঁর শিক্ষনপ্রণালীর মধ্যে একটা অসাধারণত্ব লুকিয়ে ছিল। আমার জানা এরকম খুব কম শিক্ষকই আছেন, এবং জীবনের প্রথম বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে তাঁকে পেয়ে নিজেকে আমি ভাগ্যবান মনে করি,” বলেছিলেন তিনি।
স্কুলের পাঠ শেষ হওয়ার পর মাদুরাইয়ের আমেরিকান কলেজ ও মাদ্রাস খ্রীস্টান কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পর্ব সম্পন্ন করেন তিনি। ১৯২০তে কোলকাতায়, ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভিশন অফ সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠানে সিভি রমনের সাথে যৌথভাবে পদার্থবিদ হিসেবে জীবন শুরু করেন কৃষ্ণন। ১৯৩০ এ পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেন রমন। তাঁর কথায় রমনের সাথে কাটানো দিনগুলি ছিল ‘বিজ্ঞান জীবনের উৎসবের দিন’। এখানে কিছুদিন গবেষণাকার্যে নিযুক্ত থাকার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে পাঠক হিসেবে বেশ কিছুদিন কাজ করেন কৃষ্ণন।
শুধু ভারতেই নয়, অসংখ্য আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি পেয়েছে তাঁর কাজ। এমনকি ইংল্যান্ডের দ্যি রয়্যাল সোসাইটি অফ লন্ডনেও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গবেষণাধর্মী নিবন্ধ।
ঢাকার পর ১৯৪২ এ, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ও পদার্থবিদ্যা বিভাগ প্রধানের ভূমিকায় কাজ করেন তিনি। সারাজীবন ধরে অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন, দ্য কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের মত বৈজ্ঞানিক ও শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানগুলির সাথে অতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন।
প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে অনস্বীকার্য অবদানস্বরূপ সারা জীবন ধরে অসংখ্য সন্মান প্রাপ্ত হয়েছেন কৃষ্ণন। ১৯৪০ এ সন্মানীয় রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ অর্জনের পর ১৯৫৪ তে তাঁকে পদ্মভূষণ সন্মানে ভূষিত করা হয়। শুধু তাই নয়, অসংখ্য পুরষ্কারের পাশাপাশি প্রথম ভারতীয় হিসেবে ১৯৫৮ সালে ভত্নগড় সন্মান অর্জন করেন তিনি।
বিজ্ঞানের পাশাপাশি রাজনীতি নিয়েও বেশ আগ্রহী ছিলেন তিনি। ছেলেবেলায় বাবার কাছ থেকে পাওয়া সকল ধর্মের প্রতি যৌথ সমন্বয় সংক্রান্ত উপদেশাবলী ও ভারতীয় দর্শন তাঁর জীবন গড়ে তোলার নেপথ্যে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। নিয়ম করে অভ্যাস করতেন সাহিত্যপাঠ; ভিক্তর উগো, শেক্সপিয়র, আর্তুর কোনান ডয়েল, স্টিভেনসনের সিরিয়াস পাঠক ছিলেন।
১৯৬১ তে পৃথিবী ছেড়ে পরলোকে পারি দেন এই প্রবাদপ্রতিম ভারতীয় পদার্থবিদ। দেশবাসী তথা বিশ্ববাসীর জন্য তিনি যা উপহার রেখে গিয়েছেন, তাঁকে হৃদয়ে ও মস্তিষ্কে ধারণ করে ক্রমশ সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছেন তাঁর অনুসারীরা। পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও অবদানের কারণে ইতিহাসের পাতায় আজীবন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন কেএস কৃষ্ণন।