চিরনিদ্রায় ভারতের ডিস্কো সম্রাট

চিরনিদ্রায় ভারতের ডিস্কো সম্রাট। কথায় বলে মঙ্গলে উষা বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা। সেই বুধের প্রভাতেই ফের এক নক্ষত্র পতনের সাক্ষী থাকল ভারতীয় সঙ্গীত জগৎ। বলিউডের 'ডিস্কো কিং' ছিলেন তিনি। বলিউডে সংগীতের 'ডিস্কো যুগ' শুরু হয় তাঁর হাত ধরেই। ভারতীয় সিনেমায় 'সিন্থেসাইজড ডিস্কো মিউজিক' নিয়ে আসার পথিকৃৎ তিনি। আজও তাঁর 'ইয়াদ আ রহা হ্যায়' মানুষের মুখে মুখে ফেরে।  বলিউড এবং টলিউড, দুই ইন্ডাস্ট্রিতেই এই বঙ্গতনয় রাজত্ব করেছেন। হলিউডেও তাঁর প্রতিনিধিত্ব ছিল; ওয়েলস ডিজে, এবং প্রযোজক জেমি জোনাস-এর সঙ্গেও তাঁকে গান গাইতে দেখা গিয়েছে। তাঁর আইকনিক গান জিমি জিমি আজা আজা... হলিউড ছবি ' You Don't Mess With The Zohan's'-এ ব্যবহার করা হয়েছিল। তিনিই একমাত্র ভারতীয় মিউজিক ডিরেক্টর যিনি জোনাথন রসের লাইভ পারফরম্যান্সে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ১৯৮৯ সালে।  বিখ্যাত মার্কিনী গায়িকা লেডি গাগার সঙ্গেও গলা মিলিয়েছেন বাপ্পি লাহিড়ী। পঞ্চম যুগেও তিনি ছিলেন স্বপ্রতিভ মহম্মদ রফি, কিশোর কুমার, মুকেশ, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, বিজয় বেনেডিক্ট, শ্যারন প্রভাকরের মতো শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। 
bappi-1
​​
১৯৫২ সালের ২৭ নভেম্বর জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন বলিউডের বাপ্পি দা। তাঁর আসল নাম ছিল অলোকেশ লাহিড়ী। বাবা অপরেশ লাহিড়ি আর মা বাঁশুড়ি লাহিড়ী দুজনেই বাংলা সঙ্গীত জগতের মানুষ ছিলেন। ডাক বাপি রেখেছিলেন এক আত্মীয়া। ওই নামেই দীর্ঘ পাঁচ দশকেরও বেশি বিশ্ব কাঁপালে তিনি। বাড়িতে সঙ্গীতের চর্চা ছিল সেই ছোটবেলা থেকেই। গানের হাতেখড়িও হয়েছিল পরিবারের মধ্যেই, সেই ছোট্টবেলায়।
মাত্র ১১ বছর বয়সেই প্রথম গানে সুর দিয়ে ফেলেছিলেন বাপ্পি। বাংলা ছবি দাদুতে ১৯৭২ সালে সুর দিয়েই তাঁর সঙ্গীতের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তারপর তিলোত্তমা ছেড়ে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই বাপ্পি পাড়ি দিলেন বাণিজ্যনগরের পথে। ছেলের কারণে, বাবা-মাও গিয়েছিলেন বম্বেতে। ১৯৭৩ সালে হিন্দী ভাষায় নির্মিত নানহা শিকারী ছবিতে তিনি প্রথম গান রচনা করেন বাপ্পি, মুম্বইয়ে প্রথম ব্রেক কিন্তু এক বাঙালি পরিচালকের হাত ধরেই এসেছিল। শমু মুখোপাধ্যায় ছিলেন নানহা শিকারির পরিচালক ছিলেন। এরপর ১৯৭৫ সালে তাহির হুসেনের জখমী চলচ্চিত্রে কাজ করেন বাপ্পি।
bappi-2
বিশাল আলখাল্লা ধাঁচের জমকালো কালো কুর্তা। কালো চশমা, গলায় বেশ কয়েক ভরি সোনার হার, একমুখ হাসি এবং অজস্র সোনার গয়নার ঝলমলানি, শের দিল হৃদয় আর বলিউড ছবির দশকের পর দশক জুড়ে রাজত্ব করা একের পর এক জনপ্রিয় গান। এই হল সঙ্গীত অনুরাগীদের বাপ্পি লাহিড়ী! বাপ্পিদা!
বলিউড তথা ভারতীয় দর্শক তাঁর হাত ধরেই 'ডিস্ক সং' বা পার্টি নাম্বার চিনতে শিখেছিল। আশির দশকে দর্শকদের হিট লিস্ট দখল করেছিল এই ডিস্কো সঙ্গীত। ১৯৭০ থেকে ৮০-এর দশকে হিন্দি ছায়াছবির জগতে অন্যতম জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন বাপ্পি লাহিড়ি। বলিউডে ডিস্কো ডান্সার, ডান্স ডান্স, চলতে চলতে, শরাবি, ওয়ারদাত, নমক হালাল, কমান্ডো, সাহেব, গ্যাং লিডার, স্যায়লাব, ডার্টি পিকচারের মতো ছবিতে দুরন্ত মিউজিক করেছিলেন তিনি। বাংলায় গুরু দক্ষিনা, অমর সঙ্গী, আশা ও ভালবাসা, আমার তুমি, অমর প্রেম, মন্দিরা, বদনাম, রক্তলেখা প্রভৃতি ছবিতে সুর দিয়েছেন। গেয়েছেন বহু গান। বিচারকের ভূমিকাও সামলেছেন।
 
১৯৮৬ সালে ৩৩টি ছবির জন্য ১৮০টি গান রেকর্ড করে, গিনিস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নিজের নাম তুলে নিয়েছিলেন। খুব দ্রুত গান তৈরি করতে পারেন, আর সঙ্গে থাকত আধুনিক গতি ও নতুন ধারার মিশেলে তাঁর সুরের জাদু। এটাই তাঁকে বাপ্পি করে তুলেছিল।
bappi-3
 
দীর্ঘ ৫২ বছরের সুর সৃষ্টি জীবনে, ৫৫০টির বেশি ছবিতে কাজ করেছেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে শাদি ডট কম, বদ্রিনাথ কি দুলহানিয়া, ইন্দু সরকার, ড্যাডি, নাম শাবানা মতো বলিউডি ছবিতে কাজ করেছেন। বাংলা ছবি 'ককপিট'-এ তাঁর 'কলকাতার রসগোল্লা'র রিমিক্স শুনেছেন আপামোর বাংলার দর্শক। ২০২০ সালে বাগি- ৩ এর জন্য শেষবার ভাঙ্কাস গানটি তৈরি করেছিলেন। সালমান খানের সঞ্চালনায় রিয়েলিটি শো বিগ বস ১৫-তে অভিনেতা সাথে তাঁকে শেষবারের মতো পর্দায় দেখেন দর্শকেরা। 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...