আগামীকাল ভারত-পাকিস্তান মহারণ

সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৭ আগস্ট শুরু হল ক্রিকেটে এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। ন'মাস পর আগামীকাল ২৮ আগস্ট, রবিবার আবার ক্রিকেট মাঠে মুখোমুখি ভারত-পাকিস্তান। এশিয়া কাপে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর এই লড়াই উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে ক্রিকেট–বিশ্বে। সবার চোখ এশিয়া কাপের ভারত–পাকিস্তান লড়াইয়ের দিকেই। দু'দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের উত্তেজনা বাড়ছে। কে জিততে পারে, কে কাকে টেক্কা দিতে পারেন তাই নিয়ে তর্কবিতর্কও শুরু হয়েছে।

এ সবের মধ্যে অদ্ভুতভাবে শান্ত রয়েছেন রোহিত শর্মা। গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচ নিয়েও ভাবলেশহীন তিনি। পাকিস্তান ম্যাচ তাঁর কাছে বাকি যে কোনও ম্যাচের মতোই। ভারতের অধিনায়ক মেনে নিয়েছেন যে অত্যন্ত চাপের ম্যাচ হতে চলেছে। তা সত্ত্বেও সাজঘরের পরিবেশ যাতে স্বাভাবিক থাকে, সেই চেষ্টা করবেন তিনি। রোহিত বলেছেন, "এই ম্যাচ নিয়ে খুব ভেবে নিজেদের চাপে ফেলতে চাই না। যারা কোনও দিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলেনি বা মাত্র একটি-দু'টি ম্যাচে খেলেছে, তাদের ভাল করে এই ম্যাচের গুরুত্ব বোঝাতে চাই। আমরা পাকিস্তানকে অন্য যে কোনও সাধারণ বিপক্ষের মতোই দেখছি"। খানিকটা একই সুর ধরা পরেছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি তথা প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের গলাতেও। তার মতে, "আমি এশিয়া কাপকেই গুরুত্ব দিচ্ছি। ভারত–পাকিস্তান ম্যাচটি এশিয়া কাপেরই একটা ম্যাচ। এই ম্যাচকেই এশিয়া কাপ মনে করার কোনো কারণ নেই। এটা আমার কাছে আর দশটি ম্যাচের মতোই। আমরা যখন খেলতাম, তখন ভারত–পাকিস্তান ম্যাচকে অন্য ম্যাচের মতোই ভাবতাম। সব সময় টুর্নামেন্ট জিততে চাইতাম। এবার ভারত যথেষ্ট ভালো দল, তারা ভালো করছে। আমি আশা করি, এশিয়া কাপেও ভারতীয় দল তাদের পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা ধরে রাখবে"।

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বেই প্রথম বার পাকিস্তানের মাঠে পাকিস্তানকে হারিয়ে টেস্ট সিরিজ জিতেছিলো ভারত। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ বন্ধ হওয়ার পর থেকে আইসিসির ইভেন্টেই দেখা হয় দুই পড়শি দেশের। ভারত-পাকিস্তান প্রথম মুখোমুখি হয় ১৬ অক্টোবর ১৯৫২ সালে টেস্ট ক্রিকেটে। সেবারই প্রথমবারের মতো ভারত সফর করে পাকিস্তান। ৫ ম্যাচ টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচে ইনিংস ও ৭০ রানের বিশাল জয় পায় ভারত। ২য় টেস্টে ভারতকে ইনিংস ও ৪৩ রানে হারিয়ে টেস্টে নিজেদের প্রথম জয় পায় পাকিস্তান। ৩য় টেস্টে ভারতকে ১০ উইকেটে হারিয়ে এবং পরের দুই ম্যাচ ড্র করে পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জয়লাভ করে ভারত।

ভারত-পাকিস্তান সর্বশেষ টেস্ট খেলে ২০০৭-০৮ সালে। ২০০৭ সালের নভেম্বরে শুরু হওয়া তিন ম্যাচ টেস্ট সিরিজ ভারত জিতে নেয় ১-০ ব্যবধানে। সেটাই টেস্টে তাদের সর্বশেষ মুখোমুখি হওয়া। সর্বমোট ৫৯ টেস্টে ১২ ম্যাচ জেতে পাকিস্তান, ভারত ৯ ম্যাচ, বাকি ৩৮ ম্যাচ ড্র। যদিও বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে যাওয়ার দৌড়ে থাকা ছ'টি দেশের মধ্যে সবাইকে পিছনে ফেলে ১৫ বছর পর টেস্টে মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা রোহিত-বাবরদের।

ভারত-পাকিস্তান প্রথম ওয়ান ডে খেলে ১৯৭৮ সালে। ভারত সেবার বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তান সফর করে। মাঝে ১৯৬২ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত আন্তঃদেশীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটে। বিশেষ করে ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যু্দ্ধের প্রেক্ষিতে খেলা মাঠে গড়ায়নি। তাই ভারতের '৭৮ সালের পাকিস্তান সফর ক্রীড়াপ্রেমীদের আনন্দ দিয়েছিল। ওয়ানডেতে দু'দলের প্রথম দেখায় ভারত ৪ রানে ম্যাচ জিতে নেয়। পরের দু'টি জিতে নিয়ে অবশ্য ৩ ম্যাচ সিরিজটি ২-১ ব্যবধানে জয়লাভ করে পাকিস্তান। একদিনের ম্যাচে দু’দলের ১৩২ দেখায় পাকিস্তান জিতে নেয় ৭৩ ম্যাচ, ভারত ৫৫ ম্যাচ। অমীমাংসিত থাকে বাকি ৪ ম্যাচ।

ফুটবল বিশ্বে যেমন আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিল তেমনি ক্রিকেটে ভারত বনাম পাকিস্তান একটা আলাদা মাত্রা যোগ করে, একথা অস্বীকার করা শক্ত। খেলার মাঠের এক স্পোর্টিং যুদ্ধই বটে। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, মাঠের লড়াই ছাপিয়েও কখনো কখনো বিতর্কিত মুহূর্তগুল চর্চায় অধিক স্থান পায়। লড়াইটা ব্যাটে বলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি বেশ কয়েকবার। এই চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইন্ধন জোগায় দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক, সীমান্তের পরিস্থিতি এমনকি সমর্থকরাও। উত্তেজক ম্যাচে দুই দলের ক্রিকেটারদের প্রায় হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে।

১৯৯৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে ছিলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। সেই ম্যাচের মাঠে ভেঙ্কটেশ বনাম সোহেলের মধ্যকার ঘটনা এখনও ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়ে তাজা। পাকিস্তানের হয়ে আমির সোহেল দারুণ ছন্দে ব্যাট করছিলেন। ভারতের কোনও বোলারকেই রেয়াত করছিলেন না। অর্ধশতরানের পর ভেঙ্কটেশ প্রসাদের বলে বাউন্ডারি হাঁকিয়েই স্লেজ করেন। ইশারায় বুঝিয়ে দেন, ফের ওদিকেই বল মারবেন। মুখের উপর জবাবটা পরের বলেই দিয়েছিলেন প্রসাদ। আমির সোহেলের উইকেট ছিটকে দিয়ে ওই একই কায়দায় মাঠের বাইরে যাওয়ার ইশারা করেন।

১৯৯২ বিশ্বকাপে মিয়াঁদাদের ভেংচিও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। উইকেট কিপার কিরণ মোরে সচিন তেন্ডুলকরের বলে জোরদার আউটের আবেদন করেন। আম্পায়ার পাত্তা না দেওয়ায় কিরণ মোরেকে ভেঙিয়ে হঠাৎ ব্যাঙের মতো লাফিয়ে ওঠেন। মিয়াঁদাদের এই ভঙ্গিমার পর দু'জনের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ চলে কথা কাটাকাটি।

ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেটের সম্পর্ক শুধুই বৈরিতার, এটা ভাবলে আপনি ভুল করছেন। প্রচণ্ড ক্রিকেটীয় দ্বন্দ্ব ছাপিয়ে দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে বিভিন্ন সময়ই দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেছে। ইমরান-কপিল দেব, ওয়াসিম-শচীন থেকে শুরু করে শোয়েব মালিক-যুবরাজ, আফ্রিদি-জহির খান, বিভিন্ন প্রজন্মের এ ক্রিকেটারদের মধ্যে দারুণ সম্পর্ক দেখা গেছে। বর্তমানে কোহলি-আমিররাও সুযোগ পেলেই পরস্পর বন্দনায় মেতে ওঠেন। কিছুদিন আগেই কোহলির হয়ে সওয়াল করেছেন বাবর।

এসব ছাড়াও ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের অন্যতম বৈশিষ্ট হল ভারতের ব্যাটিং বনাম পাকিস্তানের পেস বোলিং। দুটোই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ। দশকের পর দশক একের পর এক অসংখ্য বোলার উপহার দিয়েছে পাকিস্তান ক্রিকেট যাঁরা দীর্ঘ সময় শাসন করেছে ক্রিকেট বিশ্বকে। এই তালিকায় ওয়াসিম আক্রম, ওয়াকার ইউনিস, ইমরান খান, শোয়েব আখতার, মহম্মদ আমির, মহম্মদ সামি, মহম্মদ আসিফ থেকে শুরু করে বহু এমন ক্রিকেটার রয়েছেন যাঁদের নাম নিয়ে শেষ করা যাবে না। ভারতের ব্যাটারদের তালিকাটা একই রকম লম্বা। শচীন তেন্ডুলকার, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষণ, বীরেন্দ্র সেওয়াগ, যুবরাজ সিং, মহম্মদ আজাহারউদ্দীন, মহেন্দ্র সিং ধোনি থেকে এখন কার বিরাট কোহলী, রোহিত শর্মা, কে এল রাহুল, ঋষভ পান্থ। এই তালিকাও চলবে।

ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে আনন্দের বিষয় হল, এবছরের এশিয়া কাপের সূচি এমন ভাবে করা হয়েছে, যেখানে তিন বার ভারত-পাকিস্তানের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা। এশিয়া কাপের সূচি অনুযায়ী, গ্রুপ 'এ'-তে রয়েছে দুই দেশ। আগামকাল সেই খেলা। এই গ্রুপে খেলবে যোগ্যতা অর্জনকারী আরেকটি দেশ। অঘটন না হলে গ্রুপের প্রথম দু'টি স্থানে থাকবে ভারত এবং পাকিস্তান। দু'দেশই উঠে যাবে সুপার ফোরে। সেখানে প্রতিটি দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে খেলবে। ফলে ভারত এবং পাকিস্তানের আবার মুখোমুখি হওয়ার কথা। সেই ম্যাচটি হতে পারে ৪ সেপ্টেম্বর।

সুপার ফোর হবে রাউন্ড রবিন ফরম্যাটে। ফলে ভারত, পাকিস্তান যদি সুপার ফোরে প্রথম দু'টি স্থানে শেষ করে, তা হলে ১১ সেপ্টেম্বর ফাইনালেও মুখোমুখি হবে দুই দেশ। সে ক্ষেত্রে ১৫ দিনের মধ্যে তিন বার বিরাট কোহলী এবং বাবর আজমের দ্বৈরথ দেখা যেতে পারে। এখানেই শেষ নয়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও একই গ্রুপে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান। ২৩ অক্টোবর মেলবোর্নের সেই ম্যাচের সব টিকিট ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে।

এশিয়া কাপের সবচেয়ে সফল দল ভারত। এই টুর্নামেন্টের ওয়ানডে টি–টোয়েন্টি সংস্করণ মিলিয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে মোট ১৪ বার খেলতে নেমেছে ভারত। এই দুই দলের এশিয়া কাপ–লড়াইয়ে সফল দল ভারতই। ১৪ ম্যাচে ভারতের জয় আটটি, পাকিস্তান পাঁচবার জিতেছে, একটির ফলাফল হয়নি। ২০১০ সালের পর এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত হেরেছে মাত্র এক বার। ২০১৪ সালে ঢাকায়। ২০১৮ সালে শেষ বার এশিয়া কাপে ভারতের নেতা ছিলেন রোহিতই। তৎকালীন অধিনায়ক বিরাট কোহলী বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এ বার রোহিত পূর্ণ সময়ের অধিনায়ক। কোহলীও রয়েছেন দলে। চোট সরিয়ে দলে ফিরেছেন সহঅধিনায়ক রাহুলও।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...