কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা আমাদের এই স্বাধীনতা

১৯০৮ সাল। সেই যে-বছর বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু, কানাইলাল দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু দেশের জন্য নির্ভীকভাবে ফাঁসির দড়ি বরণ করে আত্মদানের প্রবল প্রেরণা হয়ে উঠেছিলেন; সেই বছরই জন্ম নিয়েছিলেন বীরবিপ্লবী বিনয়কৃষ্ণ বসু। ইতিহাস তাঁকে ‘বিনয় বসু’ নামে স্মরণ করে। তাঁর বাবা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। স্বভাবতই বিনয় ছিলেন বনেদি-সচ্ছল পরিবারের সন্তান। পড়াশুনোয় বেশ ভালো। তাঁর ছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। ভর্তি হয়েছিলেন মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে ডাক্তারি পড়ার জন্য। বড় ডাক্তার, নামী ডাক্তার হয়ে ওঠার প্রবল সম্ভাবনা ছিল তাঁর। সেই জায়গা থেকে কী দরকার ছিল তাঁর বিপ্লবীদল ‘বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার’-এ নাম লেখানোর? উজ্জ্বল ভবিষ্যত ও সুখের হাতছানিকে উপেক্ষা করে নিশ্চিত মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার? বিপ্লবীদলের সদস্য হওয়া মানেই তো সম্মুখ সমর, যে কোন সময় মৃত্যু। গান্ধিজি বলেছিলেন ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’; বিপ্লবীরা তো সেটা চর্যার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতেন। তাহলে?

6643174aea987418c42eb49c24589d2c (1)

আসলে তাঁরা আবেদন-নিবেদিনের বিপ্রতীপে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শাসকের মনে ভীতির সঞ্চার করে স্বাধীনতা অর্পণে বাধ্য করতে। সে-কাজে বিপ্লবীরা সফল হয়েছিলেন। তাই নৃশংস পুলিশ ইনস্পেক্টার লোম্যানকে নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে হত্যা করে বিনয় বসু এক সময় ইংরেজের এতটাই আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছিলেন যে, তাঁর মাথার দাম পাঁচ হাজার থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছিল দশ হাজার। চট্টগ্রামের বিপ্লবী নেতা মাস্টারদা সূর্য সেনের বৈপ্লবিক কাজকর্মে ভীত ও আতঙ্কিত ইংরেজ তাঁর মাথার দামও তিন হাজার থেকে বাড়িয়ে দশ হাজার করেছিল।

‘মাস্টারদা’ নামে সকলের প্রিয় সূর্য সেন ছিলেন উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের অঙ্কের শিক্ষক। অসম্ভব ভালো পড়াতেন তিনি। তারই জোরে হয়ে উঠেছিলেন সকলের প্রিয়। ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্র। সেটুকু সম্বল করে আর-পাঁচজন নিষ্ঠ শিক্ষকের মতোই সহজ নিস্তরঙ্গ পরিপূর্ণ গার্হস্থ্যজীবন স্ত্রীকে নিয়ে তিনি কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তার পরিবর্তে বেছে নিলেন এক দুঃসাহসিক জীবন। বিবাহ করেও বিবাহধর্ম পালন করলেন না। গার্হস্থ্য জীবন থেকে নিজেকে ও স্ত্রীকে নির্লিপ্তভাবে বঞ্চিত করলেন। দেশের স্বাধীনতা আনতে নিঃশেষে বিলিয়ে দিলেন নিজেকে। কারগার বরণ করলেন, বন্দিদশায় অকথ্য অত্যাচার সহ্য করলেন, ফাঁসির মঞ্চে আত্মবিসর্জন দিলেন। যে স্বাধীনতা নিজে উপভোগ করতে পারবেন না; সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এভাবেও নিজেকে বিলিয়ে দিলেন! আজ ভাবতে অবাক লাগে, কীভাবে পারলেন!

মাস্টারদারই বিপ্লবীদলের সৈনিক রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। তিনি মাত্র একুশ বছর বয়সে কুখ্যাত পুলিশ ইন্সপেক্টার জেনারেল টি জে ক্রেইগকে হত্যার চেষ্টার দায়ে বিচারের প্রহশনে নির্ভীকভাবে ফাঁসির মঞ্চে আত্মদান করেন। হয়ে ওঠেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মতো বীর বিপ্লবীদের দেশের জন্য আত্মদানের প্রেরণা। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান রামকৃষ্ণ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। মেট্রিক পরীক্ষায় জেলার মধ্যে প্রথম হয়ে বৃত্তি পেয়েছিলেন। পড়াশুনো করছিলেন বিজ্ঞান নিয়ে। তাই বাবা-মা সংসারের উন্নতির আশা নিয়ে তাঁর মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। সেই সময় মেধা থাকলে, শিক্ষা থাকলে মোসাহেবি না-করেও ভালো চাকরি ছিল বাঁধা। রামকৃষ্ণের ভবিষ্যৎ সেই দিক থেকে ছিল দারুণ উজ্জ্বল। সেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আহ্বান উপেক্ষা করে কীসের নেশায় এই স্বার্থহীন আত্মত্যাগের পথ বেছে নিলেন তিনি? মাত্র একুশ বছর বয়সে জীবন শেষ করে দেওয়ার রায় শুনেও সামান্য আফসোস পর্যন্ত করলেন না! যেখানে মানুষ আকণ্ঠ সুখে আজীবন বাঁচার স্বপ্ন দেখে, সেখানে সদ্য যুবক এই মানুষটি মৃত্যুর পরোয়ানা শুনেও অবিচল রইলেন কী করে!

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারও ছিলেন স্কুল-কলেজের উজ্জ্বল ছাত্রী। সম্মুখে ছিল শিক্ষকতার হাতছানি। বাড়ি থেকে ভালো পাত্রে বিবাহের বন্দোবস্ত পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই উজ্জ্বল সুখী জীবনের আয়োজন সমস্তই ফুৎকারে উড়িয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইতে শামিল হয়ে হয়েছিলেন তিনি। নারীমনের চিরন্তন সংসার-বাসনার অনেক ঊর্ধে উঠে দেশমুক্তির সাধনায় নিজেকে তিলে তিলে আত্মদানের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। প্রাণপণ লড়াই করে বীরাঙ্গনার মতো মৃত্যুবরণ করেছিলেন। অথচ প্রথার গতে চললে তাঁর জীবনটা অন্যরকম হত। সেই অন্যরকম জীবনের টান যে অমোঘ! সেই টান উপেক্ষা কবলেন কী করে? কীসের নেশায়, কীসের আশায়?

আর-এক বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে বুড়িবালামের যুদ্ধের অকুতভয় সৈনিক হিসেবে আমরা সকলেই জানি। বাঘের সঙ্গে যে বীরত্বময় লড়াইয়ের জন্য তাঁকে ‘বাঘাযতীন’ নামে ডাকা হয়, তাও আমরা জানি। আমরা অনেকেই জানি না, চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সে তিনি ছিলেন যথেষ্ট সংসারী মানুষ। টাইপরাইটারে টাইপ করতে এবং স্টেনোতে ছিলেন খুব দক্ষ। বাংলা সরকারের অর্থসচিব হেনরি হুইলারের স্টেনোগ্রাফারের চাকরি করতেন। অসম্ভব ভালো মাইনে পেতেন। স্ত্রী ইন্দুবালা, কন্যা আশালতা, তিন পুত্র অতীন, তেজেন ও বীরেনকে নিয়ে ছিল তাঁর ভরা সংসার। এমন সংসারী মানুষেরা, যাঁদের পিছুটান আছে, তাঁরা সাধারণত নির্বিবাদী থাকতে চান।

কিন্তু যতীন্দ্রনাথ ছিলেন অন্য ধাতুর মানুষ, তিনি নির্বিবাদী থাকতে পারেননি। নিছক সংসারী মানুষ হয়ে পরাধীন দেশের উদাসীন ও স্বার্থপর নাগরিক হয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারেননি। সংসারের ভাবনা জলাঞ্জলি দিয়ে ইংরেজের চাকরিকে পায়ে ঠেলে অস্ত্রহাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইতে। সম্মুখসমরে বীরের মতো প্রাণ দিয়েছিলেন। আজ মনে হয়, কীভাবে পেরেছিলেন সাজানো সুখ ছেড়ে এই নিশ্চিত আত্মদানের পথে এগিয়ে আসতে! কীভাবে!

সমসাময়িক বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন অসাধারণ মেধাবী ছাত্র। মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। বাড়ির কাছে সুখের চাকরি ছেড়ে কী দরকার ছিল তাঁর বৈপ্লবিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার! সুখে সংসার করে জীবনটা কাটিয়ে তো দেওয়াই যেত অনায়াসে!

যেত। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ সে পথে না গিয়ে হেমচন্দ্র কানুনগোর সঙ্গে মেদিনীপুরের বৈপ্লবিক সংগঠন গড়ে তোলায় আত্মনিয়োগ করলেন। আলিপুর বোমার মামলায় অন্যদের রক্ষা করতে বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে হত্যা করে নিশ্চিত ফাঁসিকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিলেন। তিনি নিজে ধরা পড়েছিলেন বে-আইনি অস্ত্র রাখার দায়ে। তাতে আর যাই হোক, ফাঁসি হত না। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে নিজের জীবন দান করতে এই মানুষটি দ্বিধা করেননি। কীভাবে পেরেছিলেন এই কাজে ব্রতী হতে! এ-কাজ হঠকারিতা তো নয়, অনেক ভাবনা, অনেক আয়োজনে ঠাণ্ডা মাথার কাজ। অসুস্থতার ভান করে হাসপাতালে গিয়ে, সেখানে অস্ত্র আনিয়ে, সেখানে নরেনকে ডাকিয়ে হত্যা—একেবারেই সহজ কাজ ছিল না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু বিনয় বসু নন, সূর্য সেন নন, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস নন, যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বা সত্যেন্দ্রনাথ বসু নন; তাঁদের মতো অসংখ্য বিপ্লবী ছিলেন, যাঁরা চাইলে অন্যক্ষেত্রে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠ করতে পারতেন, আর-পাঁচজনের মতো সুখী জীবন কাটিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তা না-করে তাঁরা নিশ্চিত আত্মবিসর্জনের পথটিকেই বেছে নিয়েছিলেন নিঃস্বার্থভাবে।

হ্যাঁ, নিঃস্বার্থভাবে। এঁরা সকলেই জানতেন যে, সশস্ত্র বিপ্লবের পথের বাঁকে বাঁকে রয়েছে অকথ্য পুলিশী অত্যাচার আর নিশ্চিত মৃত্যু। তাঁরা জানতেন যে, যে-স্বাধীনতা অর্জনের জন্য লড়াই করছেন, তা তাঁরা হয়তো দেখে যেতে পারবেন না, তাকে উপভোগও করে যেতে পারবেন না। ইতিহাস তাঁদের মনে রাখবে কি না, সে-ভাবনায় তাঁরা ভাবিত হননি। সংসার তাঁকে ছাড়া চলবে কি না, সেই দুশ্চিন্তায় বিচলিত হননি। তাঁরা নেতা হতে আসেননি। নেতা হয়ে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে আসেননি। দেশের জন্য নিজেকে নিঃস্বার্থে বিলিয়ে দিতে এসেছিলেন।

তাঁরা পড়তে পেরেছিলেন সর্বকালের ইতিহাসের লিখন। বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতা ভিক্ষা নয়, তা চেয়েচিন্তে পাওয়া যায় না; তাকে জীবন দিয়ে অর্জন করতে হয়। তার জন্য রক্তপিছল পথে আত্মবলিদান দিতে হয়। সেই বলিদান তাঁরা দিয়েছিলেন ভবিষ্যৎ দেশবাসীর মুক্ত ভবিষ্যতের জন্য। সেটাই ছিল তাঁদের কাছে সুখেরদান। কবি কামিনী রায় ‘সুখ’ কবিতায় লিখেছিলেনঃ

‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি,

এ জীবন মন সকলি দাও;

তার মতো সুখ কোথাও কি আছে?

আপনার কথা ভুলিয়া যাও।

পরের কারণে মরণেও সুখ,...’।

 

কবিতার এই ভাবটিই যেন ছিল বিপ্লবীদের সেই সুখময় আত্মদানের বীজমন্ত্র। এই মন্ত্রেই ইতিহাস এগিয়েছে রক্তমাখা পায়ে, বলিদান বয়ে এনেছে স্বাধীনতা। স্বাধীন দেশের তেরঙা পতাকার রঙে রঙে লেখা আছে সেই বলিদানের দৃপ্ত স্মৃতিকথা। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে তাই এই মহান তেরঙার পদতলে শ্রদ্ধানত হয়ে দাঁড়িয়ে আজ আমাদের সেই স্মৃতিকথা সজলনেত্রে উদাত্তকণ্ঠে পাঠ করতে হবে, উদ্বেলিত হতে হবে সমস্ত সংগ্রামী-শহিদের বন্দনাগানে; মনে রাখতে হবে, তাঁরা ছিলেন বলেই আজকের এই আমরা, তাঁরা সংগ্রামে শহিদ হয়েছিলেন বলেই আমরা পেয়েছি স্বাধীনতার স্বাদ। মাস্টারদা মৃত্যুর আগে শেষ ভাষণে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেনঃ

তোমাদের কাছে শুধু এক অন্তিম অনুরোধ রেখে যাই—দলাদলি করে দেশকে ডুবিও না। শাসকের নাগপাশ আমার কণ্ঠরোধ করলেও আমার এ কথা তোমরা মনে রেখো।–বন্দে মাতরম!

 

মাস্টারদার এই শেষ অনুরোধ আমরা যেন স্বাধীনতার শতবর্ষের পদযাত্রায় ভুলে না-যাই। সেটাই হবে তাঁদের নিঃস্বার্থ সংগ্রাম ও আত্মদানের প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা...                        

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...