বীরাঙ্গনা এই দলিত কন্যা ছিলেন অবিকল রানী লক্ষ্মী বাঈ

ঠিক সেই একই রকম ভঙ্গি, মাথায় পাগড়ি, একই হাতে তলোয়ারের ভঙ্গীও একই, ঘোড়ার পিঠে টানটান আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গী বলে দেয় রণাঙ্গনে সহজ নয় এই বীরকে পরাস্ত করা। প্রথম দেখায় মনে হবে এ মূর্তি ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী-বাইয়ের। কিন্তু ভুল ভাঙে মূর্তির পরিচিতি ফলকে। এই মূর্তি ঝলকারি বাঈয়ের।

তিনি কোনও রানী নন। বরং জাতপাতের বিচারে জর্জরিত দেশে তিনি চিহ্নিত হন ‘দলিত রমনী’ হিসেবে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে ঝলকারী বাই যুদ্ধ করেছেন রানীর মতোই। ঝাঁসি যখন বিপদে তখন লড়াই করেছেন বুক চিতিয়ে। মৃত্যুও হয় রণাঙ্গনেই।

1839-Jhalkari-Bai-India-Stamp-2001-188x250

অবিকল রানী লক্ষ্মী বাইয়ের মতো দেখতে তাঁকে। শৌর্যে বীর্যেও। তাঁকে দেখে চমকে গিয়েছিলেন ঝাঁসির রাজমাতা। স্বামী পুরণ কোরি ছিলেন রাজা গঙ্গাধর রাও ঝাঁসি সেনা দলের সদস্য। স্বভাব বীর পুরণ স্ত্রীকে কখনও বাধা দেননি শোর্য চর্চায়, বলা যায় এগিয়ে দিয়েছিলেন।

১৮৩০ সালে ঝাঁসির ভোজলা গ্রামে জন্ম। বাবা সাদোবা সিং, মা যমুনা দেবী। তাঁদের একমাত্র কন্যা ঝলকারী। খুব ছোটবেলায় মাকে হারাতে হয়। বাবার হাতে মানুষ ঝলকারি ছোট থেকেই গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ের থেকে আলাদা। অসম্ভব সাহস তার, কিছুতেই ডরায় না। দলিত কোরি সম্প্রদায়ের মানুষ তারা। অভাব নিত্যদিনের সঙ্গী। ভাত-কাপড়ের জোগান দিতেই হিমশিম পড়াশোনা হবে কোথা থেকে। তার ওপর নিম্নবর্ণ । বইয়ের পাঠ থেকে দূরে থাকলেও মেয়েকে অস্ত্রশিক্ষা আর ঘোড়া সোওয়ারীর পাঠ দিচ্ছিলেন বাবা। মেয়েও হচ্ছিল চাবুক হয়ে।

একবার ডাকাত পড়ল তার এক পড়শীর বাড়িতে। ভয়ে তটস্থ মানুষজন। কে কাকে বাঁচাবে। ছুটে গিয়েছিল কিশোরী ঝলকারী। একাই কাবু করেছিল ডাকাত দলকে। তারপর থেকে গাঁয়ের লোকের মুখেমুখে ফিরতে লাগল তার সাহসের গপ্পো। আর একবার বাঘ পড়ল গাঁয়ে। কুড়ুল দিয়ে বাঘটিকে নিকেশ করে সে। গাঁয়ের লোক মুগ্ধ তার বীরত্বে। দূর গাঁয়ে ছড়িয়ে গেল তার বাঘ শিকারের কথা।

ঝলকারি বাঈয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল গঙ্গারাও সেনাবাহিনীর বীর সেনা পুরণ কোরির সঙ্গে। একবার গৌরি পুজোর সময় অন্য মহিলাদের সঙ্গে ঝলকারি রাজপ্রাসাদ চত্বরে যান রানী লক্ষ্মী বাঈকে সম্মান পৌঁছে দিতে। সাদৃশ্যের জন্য ঝলকারি চোখে পড়ে যান রানীর। তিনি অবাক হয়ে যান ঝলকারিকে দেখে।

রানী লক্ষ্মীবাঈ ঝলকারি বাঈয়ের সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ নিতে শুরু করে। তাঁর সাহসের গল্প শোনার পরই দুর্গা বাহিনীতে যোগদানের আদেশ পাঠান। বাহিনীতে ঝলকারির বন্দুক চালনার প্রশিক্ষণ শুরু হয়।

দুর্গা বাহিনীতে দ্রুত নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠলেন তিনি। একসময় নেত্রীপদে আসেন। হয়ে ওঠেন রানী লক্ষ্মী বাঈয়ের অন্যতম পরামর্শদাত্রী।   

ভারতে তখন লর্ড ডালহৌসির শাসন নীতি চলছে। রানী লক্ষ্মী বাঈ পুত্র দত্তক নেন। কিন্তু ব্রিটিশরা নিঃসন্তান রানী লক্ষ্মী বাঈকে দত্তক পুত্র নেওয়া অনুমতি দেয়নি। তারা তখন দখল নিতে চাইছে রাজ্য।

ব্রিটিশদের শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ না করে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তোলার পরিকল্পনা করেন রানী লক্ষ্মীবাঈ। এপ্রিল ১৮৫৭ সালে, মহাবিদ্রোহের সময় সরাসরি ইংরেজ বিরোধীতার সিদ্ধান্ত নেন রানী। ইংরেজদের বিরুদ্ধে রানী লক্ষ্মী বাঈয়ের আক্রমণ পরিকল্পনা নিষ্ফল হয়ে যায় স্থানীয় বিশ্বাসঘাতকতার কারণে।

রানীর সেনা নায়কের মধ্যে একজন দুলহেরাব নামে সেনানায়ক রাজমহলের গুপ্ত দ্বার ইংরেজ সেনাদের জন্য খুলে দেয়। যখন রাজমহলের পতন নিশ্চিত তখন ঝলকারির পরামর্শে রানীর সেনাপতি ও ঝলকারী বাঈ কিছু সৈন্য প্রাসাদ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রানী পুত্র ও কয়েকজন বিশ্বাসী অনুচর নিয়ে ঝাঁসির রাজমহল থেকে বেরিয়ে পড়েন।

ঝলকারী বাঈয়ের স্বামী পুরন কোরি ইংরেজদের হাতে শহীদ হন। ঝলকারী বাঈ স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়েও যুদ্ধে অটল। ঝলকারী বাঈ, রানী লক্ষ্মীয়ের অস্ত্র ও সজ্জায় সেজে ঝাঁসির সেনা কামান নিজের দায়িত্বে নেন। তারপর  ব্রিটিশ জেনারেলের শিবিরে দেখা করার জন্য রওনা দেন। ব্রিটিশ শিবিরে পৌঁছতেই তিনি চিৎকার করে বলেন আমি জেনারেলের সঙ্গে দেখা করতে চাই। বুন্দেলখন্ডের প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী, জেনারেল ও তার সৈনিক খুবই আনন্দিত হয় যে, ঝাঁসির রানী তাদের অধীনে। জেনারেল ঝলকারী বাঈকেই লক্ষ্মী বাঈ মনে করেছিল। জেনারেল বলে, ‘তোমার সঙ্গে কী করা উচিত, ঝলকারী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, আমাকে ফাঁসি দাও। জেনারেল, ঝলকারীর সাহস ও নেতৃত্ব ক্ষমতা দেখে শিহরিত হয় ব্রিটিশ সেনানায়করা। তার তাঁকে ছেড়ে দেয়। তবে বিপরীত একটি মত বলে যুদ্ধ ক্ষেত্রেই মৃত্যু হয় ঝলকারি বাঈয়ের। ত্বে তাঁর মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই গিয়েছে। কেউ বলে তাঁর মৃত্যু সন ১৮৫৮ আর একটি সূত্র বলে ১৮৯০ পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন।

দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ঝলকারি বাঈ বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গেলেও আজও ঝাঁসি, বুন্দেলখন্ড আর রাজস্থানের লোকথায় মুখে মুখে ফেরে এক দলিত নারীর ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিংহ বিক্রমের কাহিনি। তাঁকে নিয়ে বাঁধা হয় গান। দলিত সম্প্রদায়ের কাছে ঝলকারি বাঈ আজও দেবীর সম্মান পান। তাঁর সম্মানে পালন করা হয় ঝলকারি জয়ন্তী। ভারত সরকার তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশেষ ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া রাধা কৃষ্ণ জগরলামুদি পরিচালিত মণিকর্ণিকা: দ্য কুইন অব ঝাঁসি ছবিতে ঝলকারি বাঈয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অঙ্কিতা লোখান্ডে।

 

 তথ্যসূত্রঃ

Indianculture.gov.in

Amritmohotsav.nic.in

 

The Betterindia

Dalithistorymonthmedium.com

 

 

 

 

    

       

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...