বসন্তকাল আর দোলযাত্রা যেন একটা মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ এমন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে এই দুইয়ে একে অপরকে। ফাল্গুন মাস এলেই মনে হতে থাকে রঙের উৎসব কবে আসবে। সমগ্ৰ ধরা, আকাশ, বাতাস জুড়ে বসন্তের জয়গাথা যেন বেজে ওঠে সুরে সুরে ......
"বসন্ত তার গান লিখে যায় ধূলির 'পরে কী আদরে॥
তাই সে ধূলা ওঠে হেসে বারে বারে নবীন বেশে,
বারে বারে রূপের সাজি আপনি ভরে কী আদরে॥
তেমনি পরশ লেগেছে মোর হৃদয়তলে,
সে যে তাই ধন্য হল মন্ত্রবলে।
তাই প্রাণে কোন্ মায়া জাগে, বারে বারে পুলক লাগে,
বারে বারে গানের মুকুল আপনি ধরে কী আদরে॥
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
বাঙালির তো বারো মাসে তেরো পার্বণ। যখন তখন যে কোনও উৎসব প্রসঙ্গেই আমরা বলি দোল-দুর্গোৎসব। কিন্তু দোলের দিন তো আর সত্যিই দুর্গাপুজো হয় না। তবে ব্যতিক্রম তো সব জায়গায় সব কিছুর ক্ষেত্রেই দেখা যায়। এমনই এক উদাহরণ রয়েছে হুগলির এক অতি প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ শহর শ্রীরামপুরে। সেখানে দোলের দিনই সত্যি সত্যিই শুরু হয় দুর্গাপুজো। শাক্ত ধর্ম আর বৈষ্ণব ধর্মের কি অপূর্ব মিলন ঘটে এখানে। দোল উৎসবের তিথিতে দশভুজা দুর্গা পূজিতা হন মহিষমর্দিনী রূপে।
সমগ্ৰ দেশের মানুষ যখন রঙে রঙে রঙিন হওয়ার খুশিতে মেতে ওঠেন, প্রায় সর্বত্রই যখন চলে রাধাকৃষ্ণের আরাধনা, তখন হুগলীর শ্রীরামপুর সাক্ষী থাকে এক বিরল ঐতিহ্যবাহী উৎসবের। রঙের উৎসবে মেতে উঠতে যেন মর্তে চলে আসেন দেবী উমা। দোলের দিন থেকে নিয়ম মেনে শ্রীরামপুরের পঞ্চানন তলায় শুরু হয় মাতৃ আরাধনা - দুর্গা পূজা। "বন্দে মাতরম" যে বাংলার মানুষ সৃষ্টি করেছেন সেই বঙ্গদেশের এটাই বিশেষত্ব হওয়াই তো স্বাভাবিক, মা ছাড়া বাঙালির কোনও উৎসব যে সম্পূর্ণ হয় না। প্রায় ২২০ বছর ধরে চলে আসছে এই "দোল-দুর্গোৎসব" ঐতিহ্য।
১২১২ বঙ্গাব্দে শ্রীরামপুরের অভিজাত জমিদার পুলিনবিহারী দে এবং নগেন্দ্রনাথ দে দোলের দিনেই এই দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন৷ জনশ্রুতি রয়েছে যে মা দুর্গা জমিদার নগেন্দ্রনাথ দে'কে স্বপ্নে আদেশ দিয়েছিলেন দোল পূর্ণিমার দিন তাঁর পূজা আরাধনা করার জন্য। এমন স্বপ্নাদেশ পেয়েই গৃহকর্তা এই পূজা শুরু করেছিলেন। আমরা জানি, মহিষাসুরমর্দিনী আদতে দেবী দুর্গারই আর এক রূপ। তবে দে পরিবারের এই পুজোয় দুর্গার দু'পাশে কার্তিক, গণেশ, লক্ষী, সরস্বতী থাকেন না, বদলে থাকেন তাঁর দুই সখী জয়া ও বিজয়া। দুর্গা পূজার মতোই যাবতীয় নিয়ম মেনে অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে ৪ দিন ধরে পুজো হয়। দুর্গাপুজোর নির্ঘন্ট অনুযায়ীই চলে এই পুজো। এই পুজো এখন আর শুধুমাত্র দে পরিবারের পারিবারিক পুজো হিসেবে সীমাবদ্ধ নেই, এই পুজো দে বাড়ির পাশাপাশি শ্রীরামপুরের আপামর জনসাধারণেরও পুজো হয়ে উঠেছে। বর্তমানে শ্রীরামপুর টাউন ক্লাবের পরিচালনায় এই দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে।
দোলের দিন এখানকার পূজার বোধন হয় অর্থাৎ ষষ্ঠী এবং তারপর সপ্তমীর পুজো হয়। এই দিনে অঞ্চলের সব মানুষ মা'কে প্রণাম করে। এবং সপ্তমী পুজো আরম্ভ হয়। এরপর সপ্তমী পুজো শেষ হলে সকলে আবির ও রং খেলেন। দোলের পরদিন অর্থাৎ অষ্টমীর দিন কয়েক হাজার মানুষ অন্নভোগ গ্রহন করেন। পূজার কদিন স্থানীয় মানুষের হেঁসেলে মহিলাদের ছুটি থাকে অর্থাৎ রান্না বান্না বন্ধ থাকে। সবান্ধব সকলে মিলে পুজো প্রাঙ্গণে বসে ভোগ প্রসাদ গ্রহণ করেন। দোলের দিন সকালে মহিষমর্দিনী দেবীমূর্তির পায়ে আবীর দিয়ে প্রণাম করে মূর্তির সামনে স্থানীয় মহিলারা আবির খেলায় মেতে ওঠেন।
বহু পূর্বে এই পুজোর নবমী তিথিতে মহিষ ও ছাগ বলির প্রথা চালু থাকলেও বর্তমানে এই প্রথা সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে নবমীতে পুজোর ভোগে সেদিন দেবীকে মাছ নিবেদন করা হয়। শুধু এলাকাবাসীরাই নয় শ্রীরামপুর অঞ্চলের অনাথ আশ্রমের বাচ্চারাও পুজো প্রাঙ্গণে ভোগ খায়। চারদিনের এই পুজোকে ঘিরে ছোট থেকে বড় সব বয়সের মানুষ মেতে ওঠেন।
অনেক আগে পুজোর তিনদিন যাত্রাপালা হত, কবিগানের আসর জমে উঠত। তবে বর্তমানে পুজোয় ৩ দিন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। দশমীর দিন অঞ্চলের মেয়ে বৌরা সিঁদুর পরিয়ে মিষ্টি মুখ করিয়ে সাড়ম্বরে মা'কে বরণ করেন। সিঁদুর খেলার পর মা-এর বিসর্জনের পালা। বিসর্জনের দিন রাতে শোভাযাত্রা সহ শ্রীরামপুরের দে বাবুদের ঘাটে গঙ্গায় মায়ের প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যে দিয়েই শেষ হয় এই পুজো। এলাকার সব মানুষ চোখের জলে দেবী মহিষমর্দিনী দুর্গাকে বিদায় জানিয়ে বলেন "আবার এস মা গো"।।