এক কালে যেখানে নর্দমার পাঁকের গন্ধে শ্বাস নেওয়া দুষ্কর হয়ে উঠত এখন সেখানেই রাত নামে হাস্নুহানা আর যুঁই-চাঁপার গন্ধে। আবর্জনা স্তুপের পচা-মরার বিষাক্ত বাতাস এখন বদলে গিয়েছে বাতাবি-বেদানার সুবাসে।
এ যেন ঠিক ‘ছিল রুমাল আর হল বিড়ালের’ কাহিনি। ছিল পূতিগন্ধময় বস্তি এলাকা, সেই এলাকাই আজ বদলে গিয়েছে আশ্চর্য্য সুন্দর বাগান-শহরে।
ছোট ছোট টালি বা খাপরার বাড়ি। এক চিলতে ঘর-দুয়ার। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বাঁচা, তব উতা অদ্ভুত শান্তিতে জড়িয়ে রাখে। সস্তার রঙে রাঙানো দেওয়াল। কোথাও শুধু চুনকাম পড়েছে। কিন্তু সে দেওয়ালও নজর কেড়ে নেয়। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার বস্তি অঞ্চল বাঁশবাড়ি কলোনিতে। এক সময় দূষিত পরিবেশের কারণে এই এলাকায় আসতে চাইত না মানুষ। বিয়ের দেওয়া মুশকিল হত এই কলোনির বাসিন্দা হওয়ার কারণে। যেন এক আবর্জনার শহর। এমনকি প্রয়োজনে যানবাহন-গাড়ি পেতেও মুশকিলে পড়ত বাসিন্দারা। এখন যেন রাতারাতি বদলে গিয়েছে সেই ছবি।
সকাল বেলা ঘুম ভাঙলেই পাখির ডাক। বাসিন্দাদের কাছে সেটাই যেন দিন শুরুর এলার্ম। দিনের ব্যস্ততা আর কাজ শুরুর আগে আছে আরও এক কাজ। গাছের পরিচর্যা। সেই কাজে কোনওরকম ফাঁকি দিতে নারাজ তাঁরা। কারণ এই গাছগুলোই বদলে দিয়েছে তাঁদের অন্ধকার স্যাঁতস্যাতে জীবন। আলো এসেছে। ফিরেছে পাখির ডাক। আর বদলে গিয়েছে সন্তানরা।
কীভাবে? ভারী গর্ব করে সেই গল্প বলেন কলোনীর বাসিন্দারা।
এখানকার প্রবীণতমা রানুবিবির কথায়, ‘আমরা খুব কষ্টেশিষ্টে বেঁচে থাকতাম। কিন্তু আমাদের সন্তানরা এভাবে দিন কাটাতে একেবারেই চায়নি। তারা এমন পরিবেশে থাকতে চায়নি। তাদের মুখ চেয়েই এই বদল’।
একা রানুবিবি নন, এই এলাকার প্রায় সব বাসিন্দারাই এভাবে ভেবেছেন। ঘিঞ্জি বস্তির পরিবেশ বদলাতে গাছই হয়ে ওঠে তাঁদের অবলম্বন।
নানা সাইজের টব। কোনওটা প্ল্যাস্টিকের, কোনটা মাটির। পর পর সার দিয়ে রাখা প্রতিটি বাড়ির সামনে। যানলা, দরজা, বাড়ির চাল থেকে ঝুলছে লতা। বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাস, ফার্ণ, ফুলের গাছে সেজে উঠেছে বাঁশবাড়ি কলোনি। ফল এবং ঔষধী গাছ লাগিয়েছেন বাসিন্দারা। যাতে পাখিরা খাবার পায়। বাসে বাঁধে।
যাদের জন্য এই পরিবর্তন সেই কচিকাঁচারা বেজায় খুশি এই পরিবর্তনে। তারা জানিয়েছে আছে ময়লা আর দুর্গন্ধের কারণে তাদের স্কুলের বন্ধু সহপাঠীরা কেউ তাদের বাড়ি আসতে রাজী হত না, আর সব খেলা জমে তাদেরই সবুজ গলি-উঠোনে।
বাঁশবাড়ি কলোনির পরিবেশের পরিবর্তন সম্পূর্ণভাবে বাসিন্দাদের উদ্যোগে হয়েছে। তাঁরা মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন নিজেদের জীবন যাত্রার বদল ঘটাতে। বছর বছর ধরে তাঁরা থেকে এসেছেন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে । কিন্তু চেয়েছিলেন আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে তুলবেন এই ভূমিকে। এই প্রান্তিক মানুষরা সন্তানের গা থেকে তুলতে চেয়েছিলেন বস্তিতে থাকার তকমা। সেই কাজে সম্পূর্ণ সফল হয়েছেন তারা। তাঁদের দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে আরও অনেকেই।