ভারতের স্বাধীনতা লড়াইয়ের শেষ পর্যায়জুড়ে ছিলেন নেতাজি ও আজাদ হিন্দ ফৌজ। দেশত্যাগ করে নেতাজিই গড়ে তুলেছিলেন এই বাহিনী। ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদই ছিল আজাদ হিন্দের লক্ষ্যে। ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুই ছিলেন এই অস্থায়ী ভারত সরকারের সর্বাধিনায়ক ও রাষ্ট্রপ্রধান। ১৯৪৩-এ ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বোচ্চ সেনাপতি হিসেবে স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার গঠন করেন সুভাষ চন্দ্র বসু। তিনি ছিলেন এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী। আজাদ হিন্দ বাহিনীর গঠন হয়েছিল জাপানের টোকিওতে। সেই অর্থে এই বাহিনীর প্রতিষ্ঠা ছিলেন ভারতের বিপ্লবী নেতা রাসবিহানী বসু। অল্প কয়েকটি দেশ আজাদ হিন্দ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। যে নটি দেশের সঙ্গে আজাদ হিন্দ সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল, সেগুলি হল নাৎসি জার্মানি, জাপান সাম্রাজ্য, ফ্যাসিস্ট ইতালি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেট অফ ক্রোয়েশিয়া, নানজিঙের ওয়াং জিংওয়ে সরকার, থাইল্যান্ড, ব্রহ্মদেশ, মাঞ্চুকুও ও দ্বিতীয় ফিলিপাইন প্রজাতন্ত্র।
আজাদ হিন্দ সরকারের ছিল নিজস্ব ব্যাঙ্কও। এর নাম ছিল আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক। এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৪৩-এ। এই ব্যাঙ্কের ১০ টাকার কয়েন থেকে শুরু করে এক লক্ষ টাকার নোটও ছিল। এক লক্ষ টাকার নোটে ছিল সুভাষ চন্দ্র বসুর ছবি। সরকারের নিজস্ব ডাক টিকিট ও তিরঙ্গা পতাকা ছিল। নিজস্ব বিচারবিধিও ছিল। আজাদ হিন্দ বাহিনীর নিজেদের রেডিও স্টেশনও ছিল। যুদ্ধ বন্দী সেনাদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ। আজাদ হিন্দ ফৌজে সাড়ে আট হাজার সেনা ছিলেন। এতে মহিলাদের একটি ইউনিটও ছিল। আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠার রাত্রিতেই নেতাজি ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এই সরকার ভারত-ব্রহ্মদেশ যুদ্ধে ব্রিটিশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আজাদ হিন্দ বাহিনীর সৈনিকরাই সুভাষচন্দ্র বসুকে নেতাজি উপাধিতে ভূষিত করেন। আজাদ হিন্দ প্রতিষ্ঠার পরই জাপানের গ্রেটার ইস্ট এশিয়া কো-প্রসপারিটি স্ফিয়ারের পরিদর্শক হিসেবে টোকিওয় বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া সম্মেলনে যোগ দেন সুভাষচন্দ্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে জাপান আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের শাসনভার আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে তুলে দেয়। সুভাষচন্দ্র লেফট্যানেন্ট কর্নেল এ. ডি. লোকণাথনকে এই অঞ্চলের গভর্নর করে, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নাম রাখেন শহীদ ও স্বরাজ দ্বীপপুঞ্জ। আজাদ হিন্দ সরকারের পতনের আগে পর্যন্ত, এই দুই দ্বীপে আজাদ হিন্দ সরকারের শাসন অক্ষত ছিল।১৯৪৪-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের কোহিমা ও ইম্ফলের কাছে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে মুখোমুখি হয়েছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজ ইম্ফলের যুদ্ধে সাফল্যের অনন্য নজির করেছিল। কোহিমাতেও ব্রিটিশকে বেশ বেগ পাইয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় স্বেচ্ছানির্বাসিত ভারতীয়দের দুটি সম্মেলন থেকেই আজাদ হিন্দ সরকারের মূল ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে টোকিওতে, রাসবিহারী বসুর ডাকা সম্মেলনে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় স্বাধীনতা লিগ। এই লিগই ছিল জাপানের সহযোগিতায় ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে স্থাপিত প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন। ভারতকে ব্রিটিশ মুক্ত করার উদ্দেশ্যে রাসবিহারী বসু একটি মুক্তিবাহিনী গঠনের উদ্যোগে নেন। এই বাহিনীই পরবর্তীকালে আজাদ হিন্দ ফৌজের রূপ আত্মপ্রকাশ করেছিল। ১৯৪২ সালের শেষভাগে আয়োজিত দ্বিতীয় সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র বসু লিগকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হন। সুভাষচন্দ্র সেই সময় জার্মানিতে ছিলেন, তিনি সাবমেরিন করে জাপানে এসে উপস্থিত হন। ১৯৪৩ সালের ১৩ জুন সুভাষচন্দ্র টোকিওতে উপস্থিত হন। ২ জুলাই সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুরে পৌঁছন এবং অক্টোবরে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। সুভাষচন্দ্র বলেন, অস্থায়ী সরকারের কাজ হবে ভারতের মাটি থেকে ব্রিটিশদের উচ্ছেদ করা। আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্বভার গ্রহণ করে, জাপানি সহায়তায় এটিকে একটি পেশাদার সেনাবাহিনীতে রূপান্তরিত করেন নেতাজি। সেই সঙ্গে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাপান-অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে বসবাসকারী সাধারণ ভারতীয় নাগরিকদেরও ফৌজে অন্তর্ভুক্ত করেন। এছাড়াও সিঙ্গাপুর, মালয় ও হংকঙে ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের ফৌজে অন্তর্ভুক্ত করে বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করেন। ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীর যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে সিঙ্গাপুরে ১৯৪২-এ প্রথম আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠিত হয়। পরে তা ভেঙে যায়। সুভাষচন্দ্র বসু দক্ষিণ এশিয়ার বসবাসকারী ভারতীয়দের সাহায্যে আবার আইএনএ গঠন করেন এবং এই বাহিনীর নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন।
আজাদ হিন্দ সরকার ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করতে পারেনি। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের শেষভাগে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী জাপান সেনাবাহিনী ও আজাদ হিন্দ ফৌজকে পরাজিত করে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ পুনর্দখল করলে আজাদ হিন্দ সরকারের পতন ঘটে। হিটলার আত্মসমর্পন করেন। এরপর নেতাজির মৃত্যুসংবাদ প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামগ্রিকভাবে আজাদ হিন্দ সরকার ভেঙে পরে। রেঙ্গুনে আজাদ হিন্দ ফৌজের শেষ বৃহৎ সেনা আত্মসমর্পণের পরই এই সরকারে ক্ষমতার পরিসমাপ্তি ঘটে। আজাদ হিন্দের সঙ্গে সংযুক্ত ব্যক্তিদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে নিয়ে গিয়ে দিল্লির লালকেল্লায় তাদের বিচার করা হয়।
কিন্তু আজাদ হিন্দ সরকারের উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। ভারতবাসীদের মনে তীব্র ব্রিটিশ-বিরোধী অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পেরেছিল আজাদ হিন্দ বাহিনীর লড়াই। তাদের বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতে একাধিক ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলনে গড়ে উঠতে থাকে। ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মচারীরাও বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। ফলে ভারতের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ত্বরান্বিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের পরই ভারতের নানা জায়গায় শ্রমিক অসন্তোষ, হরতাল ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। নৌবিদ্রোহ শুরু হয়। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। দুই বছরের মধ্যে স্বাধীনতা লাভ করে ভারত।